জলে ডুবে গিয়েছে পটল ও ঢেঁড়শের (ডান দিকে) খেত। করিমপুরে কল্লোল প্রামাণিকের তোলা ছবি।
অতিবৃষ্টি ও বন্যার দরুণ দুই জেলার হাজার হাজার হেক্টর ধান ও সব্জির জমি জলে তলিয়ে গিয়েছে। ফলে বাজারে সব্জির যোগানে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বাজারের নিয়ম অনুযায়ী, চাহিদার তুলনায় জোগান কম থাকায় গত কয়েক দিনে দুই জেলায় সব্জির দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে।
নদিয়ার কৃষ্ণনগর, নবদ্বীপ, চাপড়া, ধুবুলিয়া, নাকাশিপাড়ার বিভিন্ন বাজারে আনাজের দাম একলাফে অনেকটাই বেড়েছে। দিন কয়েক ধরে চাপড়া বাজারে পেঁয়াজ বিকোচ্ছে ৫০ টাকা কেজি দরে। পটলের দাম কিলোগ্রাম প্রতি ২০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৩৫ টাকা। চাপড়ার বাসিন্দা কামরুল বিশ্বাস বলেন, ‘‘অস্থায়ী চাকরী করে কোনওরকমে দিন চালাই। আচমকা সব্জির দাম এতটা বেড়ে যাওয়ায় পকেটে টান পড়ছে। বাজারে গিয়ে যাই কিনতে যাচ্ছি, সব কিছুই দামই আকাশছোঁয়া।’’
একই অবস্থা মুর্শিদাবাদেও। কিলোগ্রাম প্রতি সমস্ত সব্জির দাম গত কয়েকদিনে অস্বাভাবিকহারে বেড়েছে। রবিবার জেলার বিভিন্ন বাজারে আলু বিক্রি হয়েছে ৬ টাকা দরে। কিন্তু কয়েকদিনে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ টাকা। পটল কিলোগ্রাম প্রতি ১৬ টাকা হয়েছে ৪০ টাকা। ঝিঙে দাম ২৫ থেকে বেড়ে হয়েছে ৩০ টাকা। পেঁয়াজ এক ধাক্কায় ২০ টাকা থেকে হয়েছে ৪০ টাকা। বন্যার ফলে অনেক পুকুর উপচে পড়ায় বেড়েছে মাছের দামও। কিলোগ্রাম প্রতি চারাপোনা ১৮০ টাকা, রুই ২৪০ টাকা ও কাতলা ৩৫০ টাকায় বিকোচ্ছে। কান্দির বাসিন্দা পার্থসারথী ধর ও আনারুল শেখদের কথায়, “খেত জলের নীচে থাকায় সব্জির আকাল দেখা দিয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষ সমস্যায় পড়ছেন।’’ কান্দি মহকুমা কৃষি আধিকারিক মৃদুল ভক্ত বলেন, “অতিরিক্ত বৃষ্টি ও বন্যার কারণে ফলন কম হয়েছে। সেই কারণেই সব্জির দাম বাড়ছে।”
নিম্ন চাপের জেরে ভারী বৃষ্টিতে জেলায় ক্ষতি হয়েছে ধান চাষের। কৃষি দফতর সূত্রে জানা যায়, জেলায় প্রায় ১ লক্ষ ৯৮ হাজার হেক্টর জমিতে আমন ও আউশ ধানের চাষ হয়। ভারী বর্ষন ও বন্যার আগে ১ লক্ষ ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে ধান রোয়া শেষ হয়েছিল। ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে জল জমায় ধান রোয়া যায়নি। বহু বীজতলা জলের নীচে থাকায় তা নষ্ট হতে পারে বলে আশঙ্কা কৃষি দফতরের কর্তাদের। জেলার প্রায় ২৬ থেকে ৩০ হাজার হেক্টর জমির ধান নষ্ট হয়েছে বলে মত কৃষি কর্তাদের। জেলার কান্দি, বড়ঞা, খড়গ্রাম, ভরতপুর ১ ও ২ ব্লকে ধান চাষে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। ওই পাঁচটি ব্লকে আমন ও আউশ ধানের চাষ হয় প্রায় ৮৪ হাজার হেক্টর জমিতে। তার মধ্যে রোয়া হয়েছিল শতকরা পঞ্চাশ ভাগ জমিতে। ২৩,৫০০ হেক্টর জমির ধান জলের নীচে থাকায় নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
কান্দি মহকুমার পাশাপাশি ক্ষতি হয়েছে নবগ্রাম, বেলডাঙা-২, সুতি-১ ও ২, সাগরদিঘি, ফরাক্কা ও বহরমপুরের মতো ব্লকগুলি়তেও। কৃষি দফতর সূত্রের খবর, ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের পুনরায় চাষের জন্য স্বল্পমেয়াদি ধানের বীজ বিলি করা হবে। জেলায় প্রায় পাঁচশো মেট্রিক টন ধানের বীজ বরাদ্দ হয়েছে। তার মধ্যে ২৬৫ মেট্রিক টন ধানের বীজ ক্ষতিগ্রস্ত ব্লক গুলিতে পাঠান হয়েছে।
জমি থেকে জল নামতে আরও সপ্তাহ খানেক সময় লাগবে। সেক্ষেত্রে ওই সব জমিতে কী আর চাষ করা সম্ভব হবে? কৃষি দফতরের কর্তাদের কথায়, ‘‘অগস্ট মাসের শেষ দিন পর্যন্ত ধান রোয়া যায়। সেক্ষেত্রে দু’টি পদ্ধতিতে ধানের রোয়া করা যাবে। ড্যাপগ ও রোয়াভাঙা পদ্ধতিতে।’’ ড্যাপস পদ্ধতিতে বাড়ির উঠোনে কলাপাতা অথবা ত্রিপলের উপর জৈব সার ছড়িয়ে ধানের বীজতলা করা যাবে। দু’সপ্তাহের মধ্যে ওই ধানের বীজ তুলে রোয়া করা যাবে। অনেক জমিতে দিন পনেরো আগে ধান রোয়া হয়েছে। সেখানে ধান গাছের গুছি হয়ে গিয়েছে। ওই গুছিকে বীজ হিসেবে ব্যবহার করে নতুন করে রোয়া যেতে পারে। তাতে ফলনও হবে ভালো। এ ব্যাপারে লিফলেট ছড়িয়ে চাষিদের মধ্যে সচেতনা তৈরি করা হচ্ছে বলে কৃষি দফতরের কর্তাদের দাবি। তবে বড়ঞার চাষি সঞ্জয় ঘোষ, বেল্টু শেখরা বলেন, “বিঘা প্রতি প্রায় তিন হাজার টাকা খরচ করে ধান রোয়া করেছি। তেরোদিন ধরে জমিতে জল আছে। এখনও জানিনা কতদিনে ওই জল নামবে। আবার নতুন করে চাষ করতে গেলে ক্ষতি হবে।’’
নদিয়ার ১৭টি ব্লকেই কমবেশি চাষের ক্ষতি হয়েছে। জেলার প্রায় সাতশো মৌজার ফসল বন্যায় জলের তলায় চলে গিয়েছে। নদিয়ার উপ কৃষি অধিকর্তা (প্রশাসন) বিকাশচন্দ্র বিশ্বাস বলেন, “৫৮ হাজার ৬০০ হেক্টর জমির কৃষিজ ও বাগিচা ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নষ্ট হয়ে গিয়েছে প্রায় আড়াই লক্ষ মেট্রিক টন ফসল। যার আর্থিক মূল্য ২৭৮ কোটি টাকা প্রায়।” তবে কৃষি দপ্তরের কর্তাদের অনুমান, বন্যার জল নামার পর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে।