নরম দোআঁশলা মাটির বাগড়ি এলাকা শেষ হয়ে নবগ্রামের সীমানা থেকে শুরু হয়েছে রুখু মাটির রাঢ়।
বৈশাখের দুপুরে মাটি ফুঁড়ে হলকা বইছিল আগুনের। ব্রাহ্মণী, দ্বারকা, ঝুনকা নদী আর দুটো বিশাল বিল— বসিয়া ও তেলকরে ঘেরা নবগ্রামে ফি বারের মতো এ বারও খরা পরিস্থিতি।
আদিবাসী ও তফসিলি সম্প্রদায় অধ্যুষিত নবগ্রামে পানীয় জল থেকে সেচের জল, সবেরই বড্ড টানাটানি। ফি বর্ষায় বানভাসি হওয়াও ভবিতব্য। এই বারোমাস্যার দেশে ফের এসেছে ভোট-পার্বণ। তাই বিনি পয়সায় মিলছে তালের তাড়ি আর হাঁড়িয়া। তাতে মেতে কিছু পাবলিক বলছে, ‘‘নবগ্রাম তো ছিপিএমের ভিয়েতনাম বটেক!’’ দার্শনিক ভঙ্গিতে আর এক পক্ষ বলে উঠছে, ‘‘ছিলেক বটে! অধীর সেই মিথ ভাঙ্গ্যা দিইছেক!’’
সিপিএমের প্রয়াত জেলা সম্পাদক মধু বাগ, জেলা পরিষদের প্রয়াত সভাধিপতি নির্মল মুখোপাধ্যায়, রাজ্য কমিটির সদস্য মুজাফ্ফর হোসেনের মতো তাবড় নেতা এখানের ভূমিপুত্র। কান্দি-নবগ্রামের সীমান্ত গ্রাম উগরা-ভাটপাড়ার ভূমিপুত্র আরও এক জেলা সম্পাদক প্রয়াত সত্য চন্দ্র। এক বারের ব্যতিক্রম বাদ দিলে ১৯৭৭ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত নবগ্রামের বিধানসভা রয়েছে সিপিএমের দখলে। কৃষক আন্দোলনের এই নবগ্রাম থেকে সিপিএম একাধিক বার জিতিয়ে এনেছেন লালগোলার মহারাজার বংশধর ভূস্বামী বীরেন রায়কে।
‘ভিয়েতনাম’ মিথে থাবা বসাতে গিয়ে ১৯৯১ সালের ভোটে নবগ্রাম বিধানসভার কংগ্রেস প্রার্থী অধীর চৌধুরী প্রাণ হারাতে বসেছিলেন। ভোটের দিন বাগিরাপাড়া বুথে ঢুকিয়ে পুড়িয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল তাঁকে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে নবগ্রাম থেকে জিতে মিথ ভেঙে দেন অধীর। বছর দেড়েক পরে বহরমপুর লোকসভায় জিতে নবগ্রামের বিধায়ক পদ ছাড়তে হয় তাঁকে। ১৯৯৯ সালের উপ-নির্বাচনে নবগ্রাম ফের দখল করে সিপিএম। বিধায়ক হন সিপিএমের বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নৃপেন চৌধুরী।
এ হেন কেন্দ্রে কংগ্রেস-সিপিএম জোটপ্রার্থী পোড় খাওয়া রাজনৈতিক কানাইচন্দ্র মণ্ডলের সঙ্গে টক্কর দিতে নেমেছেন আনকোরা প্রার্থী, তৃণমূলের দিলীপ সাহা। নবগ্রামের পলসণ্ডা-পমিয়া গ্রামে কান পাতলে এখনও শোনা যায়, মাঠঘাট থেকে সংগ্রহ করা শাকপাতা বিক্রি করে তা দিয়ে লেখাপড়ার খরচ জুগিয়ে খেতমজুর পরিবারের সন্তান কানাই মণ্ডলকে বিজ্ঞানে স্নাতক করেছেন তাঁর মা। কলেজের পাঠ চুকিয়েই যুব সংগঠনের হাত ধরে সিপিএমের রাজনীতিতে তাঁর হাতেখড়ি। ধাপে ধাপে উঠে এখন তিনি জেলা কমিটির সদস্য। ভোটের রাজনীতিতেও তাঁর উত্থান একই রকম। প্রথমে পঞ্চায়েত সদস্য, তার পর পঞ্চায়েত প্রধান, পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য, অবশেষে ২০১১ সালের ভোটে জিতে বিধায়ক।
প্রতিপক্ষ, বহরমপুরের ম্যাট্রিক পাশ দিলীপ সাহার রাজনৈতিক মূলধন বলতে ছাত্রজীবনে বাম মিছিলে সামান্য হাঁটাহাঁটি, আর ‘দিদি’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশীর্বাদ। লক্ষ্মীর ভাঁড়ার কিন্তু উপচে পড়ছে। ইটভাটা, চালকল, বিলাসী হোটেল মিলিয়ে ধন-সম্পত্তির মালিক তিনি। সেই তিনি বলছেন, ‘‘পঞ্চায়েত সমিতি, গ্রাম পঞ্চায়েত, সাংসদ, বিধায়ক— সবই সিপিএম-কংগ্রেসের দখলে। তবুও পথঘাট খারাপ, বেহাল বিদ্যুত, কিসান মান্ডিতে কৃষক ধান বেচতে পারে না। দালাল ধান বিক্রি করে। পাঁচ বছরে বিধায়ক কিছুই করেননি। আমি জিতলে এই সব সমস্যার সব সমাধান করব।’’
কানাই বলছেন, ‘‘বিদ্যুৎ সঙ্কটের সমাধান করতে বছর দুয়েক আগে জেলা পরিষদের সদস্য এনায়েতুল্লার বিঘা দুয়েক জমিতে সাব-পাওয়ার হাউস করা হয়। সরকারি বাজারদর অনুসারে জমির দাম ধরা হয়ছিল ২১ লক্ষ টাকা। নির্মাণ কাজ শুরু করার জন্য ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’ দেন এনায়েতুল্লা। নির্মাণ শেষ হয়েছে। মেশিনও বসানো হয়েছে।’’ এর পরে বিদ্যুত সরবরাহ করার কথা। জেলা পরিষদের কংগ্রেস সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ যাদব গুড্ডু বলেন, ‘‘এমন সময়ে এনায়েতুল্লা সিপিএম ছেড়ে তৃণমূলে গিয়ে ব্লক সভাপতি হয়েছেন। তার পরই ওই জমির দাম হাঁকেন এক কোটি ২৬ লক্ষ টাকা।’’ পাওয়ার হাউস আর চালু করা যায়নি।
কানাই বলেন, ‘‘নবগ্রাম-অনন্তপুর সড়ক ও শিবপুর-নিয়ল্লিশপাড়া সড়ক দু’টির দশা কহতব্য নয়। সেগুলি সংস্কারের জন্য আড়াই বছর আগে জেলা পরিষদ কয়েক কোটি টাকার টেন্ডার ঘোষণা করেছিল। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে আটকে দিয়েছে রাজ্য সরকার। প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনায় ৫টি রাস্তা অনুমোদন হয়ে থাকলেও তৃণমূল সরকার সেই কাজ আটকে রেখেছে অনেক দিন ধরে।’’ কৃষকের ধান কেনার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘তৃণমূলের নেতাদের কথা মতো কিসান মান্ডি পরিচালনা করে প্রশাসন। সেখানে তৃণমূলের মাফিয়া-দালালরা ধান বেচে।’’
তার পরেও অবশ্য তৃণমূল প্রার্থীর প্রত্যাশা, তিনিই জিতবেন। ভোটের অঙ্ক কী বলছে?
বলছে, জোটের দখলে রয়েছে প্রায় ৭৫ শতাংশ ভোট।
এর পরে আর কী-ই বলার থাকতে পারে?