তাপস পালের কুকথায় ঝড় তৃণমূলেরই অন্দরে

এই ক’দিন আগেও লোকসভা ভোটে যাঁরা তাঁর ছায়াসঙ্গী ছিলেন, দিনের পর দিন যে সকল তৃণমূল নেতারা তাঁকে জেতানোর জন্য প্রাণপাত করেছেন, রোদ-বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে যাঁরা তাপস পালের হয়ে প্রচার করেছিলেন, আজ তাঁরাই লজ্জায় মুখ লোকাচ্ছেন। সোমবার নাকাশিপাড়ার চৌমুহা গ্রামে তাপস পালের মন্তব্য সংবাদমাধ্যমে আসার পর থেকেই তৃণমূলের অন্দরে সমালোচনার ঝড় বইতে শুরু করেছে।

Advertisement

সুস্মিত হালদার

কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০১৪ ০১:১৩
Share:

এই ক’দিন আগেও লোকসভা ভোটে যাঁরা তাঁর ছায়াসঙ্গী ছিলেন, দিনের পর দিন যে সকল তৃণমূল নেতারা তাঁকে জেতানোর জন্য প্রাণপাত করেছেন, রোদ-বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে যাঁরা তাপস পালের হয়ে প্রচার করেছিলেন, আজ তাঁরাই লজ্জায় মুখ লোকাচ্ছেন। সোমবার নাকাশিপাড়ার চৌমুহা গ্রামে তাপস পালের মন্তব্য সংবাদমাধ্যমে আসার পর থেকেই তৃণমূলের অন্দরে সমালোচনার ঝড় বইতে শুরু করেছে।

Advertisement

এবারের লোকসভা নির্বাচনে তাপস পালকে প্রার্থী হিসাবে চাননি কৃষ্ণনগর এলাকার বেশিরভাগ বিধায়ক-নেতারা। যাঁরা সেদিন তাপস পালের হয়ে জোর সওয়াল করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন জেলা সভাপতি গৌরিশঙ্কর দত্ত ও কৃষ্ণনগরের পুরপ্রধান তৃণমূলের অসীম সাহা। লোকসভা নির্বাচনে তাপস পালের হয়ে ‘জান-প্রাণ’ লড়িয়ে দিয়েছিলেন অসীমবাবু। তিনিই ছিলেন প্রচারের অন্যতম কাণ্ডারী। কংগ্রেসের পুরপ্রধান থাকার সময় থেকেই তাঁর সঙ্গে তাপস পালের সুসম্পর্ক।

মঙ্গলবার রীতিমতো হতাশার সুরে সেই অসীমবাবু বলেন,‘‘এমন একজন সাংসদকে কৃষ্ণনগর থেকে নির্বাচিত করেছি বলে আজ আমরা লজ্জিত। অনুতপ্ত।’’

Advertisement

প্রকাশ্য মন্তব্য করতে না চাইলেও আরও অনেকেই তাদের ঘনিষ্ঠ মহলে রীতিমতো ক্ষোভ প্রকাশ করতে শুরু করে দিয়েছেন। নাম না প্রকাশ করার শর্তে জেলার এক তৃণমূল নেতা বলেন, ‘‘সোমবার বিকেল থেকে আমার বাড়িতে আর টেলিভিশন খুলতে দিচ্ছি না। বিশ্বাস করুন এক জন বাবা হিসাবে আজ আমার মেয়ের সামনে দাঁড়াতে লজ্জা হচ্ছে। কারণ আমার কলেজে পড়া মেয়ে জানে এই তাপস পালকে জেতাতে ক’দিন আগেই তার বাবা প্রাণপাত করে দিয়েছে।’’

তৃণমূল সূত্রে জানা গিয়েছে, এবারের লোকসভা নির্বাচনে তাপস পালকে প্রার্থী করা নিয়ে যথেষ্ট আপত্তি জানিয়ে ছিলেন দলের সিংহভাগ বিধায়ক-নেতা। তার প্রথম দিনের প্রচারে জেলা সভাপতিকে কিছু সময় পাশে দেখা গেলেও দেখা মেলেনি অন্যদের। তা দেখে কৃষ্ণনগরের কর্মিসভায় তাপস পালকে পাশে নিয়ে জোরদার লড়াইয়ের ডাক দেন দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর থেকে কৃষ্ণনগর লোকসভা কেন্দ্রের সমস্ত বিধায়ক ও ব্লক সভাপতিদের তাঁর হয়ে প্রচারে নামতে দেখা গেলেও কেউই খুব একটা আন্তরিক ছিলেন না। তাপসবাবুর বিরোধী এক জেলা নেতা বলেন, ‘‘সাংসদ এলাকায় তো আসতেনই না। তার উপরে ব্যবহারও খারাপ। শুধু চৌমুহা গ্রামেই নয়, এর আগেও একাধিক জায়গায় নানা অপ্রীতিকর মন্তব্য করেছেন তিনি। তাতে আমরা বারেবারে বিব্রত হয়েছি। সেই কারণেই আমরা চেয়েছিলাম তাপস পালকে যেন লোকসভা ভোটে টিকিট না দেওয়া হয়।”

বস্তুত, এর আগে একাধিকবার এই ধরণের অপ্রীতিকর মন্তব্য করে খবরের শিরোনামে এসেছেন তাপস। নাকাশিপাড়ার বহিরগাছিতে ১১ বছরের এক কিশোরী খুনের ঘটনায় পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে এমনই বিতর্কিত মন্তব্য করেছিলেন তিনি। একই ভাবে পঞ্চায়েত ভোটের আগেও কৃষ্ণগঞ্জের মাজদিয়াতে সভা করতে গিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেছিলেন। পরের দিন আবার দলের নির্দেশে সংবাদমাধ্যমকে ডেকে প্রকাশ্যে ক্ষমাও চেয়েও নিয়েছিলেন। নির্বাচনের প্রচারে গিয়ে বিরোধীদলের প্রার্থীদের নিয়ে তিনি নানান কুরুচিকর মন্তব্য করেছিলেন। চৌমুহা ও গোপীনাথপুরে তাঁর কুকথা অবশ্য সমস্ত সীমাই ছাড়িয়ে গিয়েছে।

ইতিমধ্যে এই সিডি সংবাদমাধ্যমের হাতে কী ভাবে চলে এল তা নিয়ে দলের অভ্যন্তরে শুরু হয়েছে চাপান-উতোর। তাপসবাবুর ঘনিষ্ঠদের দাবি, এই কাজের পিছনে দলেরই এক অংশের হাত আছে।

২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে সাংসদ হওয়ার পরে তাপসবাবুর অন্যতম অনুগামী ছিলেন নাকাশিপাড়া মুড়াগাছা এলাকার বাসিন্দা অজয় খা।ঁ তাপসবাবুর হয়ে তাঁকেই যাবতীয় কাজ সামলাতে দেখে এসেছেন কৃষ্ণনগর লোকসভা কেন্দ্র এলাকার মানুষ। তা নিয়ে দলের বাইরে এবং ভিতরে নানান গুঞ্জন শোনা গিয়েছে। কারণ, নাকাশিপাড়ার বিধায়ক কল্লোল খাঁ ও ব্লক সভাপতি অশোক দত্তের সঙ্গে অজয়বাবুর ‘সুসম্পর্কের’ কথা জানেন সকলেই।

এবার লোকসভা নির্বাচনে পরিস্থিতি হঠাৎ-ই বদলে যায়। প্রথম দিনই তাপস পালকে পাশে বসিয়ে জেলা সভাপতি গৌরিশঙ্কর দত্ত পরিষ্কার জানিয়ে দেন যে, দলের সঙ্গে অজয়বাবুর কোনও সম্পর্ক নেই। তাপসবাবুও তাঁর সঙ্গেও অজয় খাঁর কোনও রকম সম্পর্ক নেই বলে জানিয়েছিলেন সেই সময়। কিন্তু নির্বাচনের পর ভিতরে ভিতরে দু’জনের সম্পর্ক জুড়ছিল। এই প্রেক্ষিতে ক্ষমতার সমীকরণ বদলের জেরেই ওই সিডি প্রকাশ্যে এসেছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল।

একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠছে আলপটকা এই মন্তব্যের পিছনে অন্য কোনও কারণ লুকিয়ে আছে কি না? চৌমুহা গ্রাম পলাশিপাড়া বিধানসভা এলাকায়। এই বিধানসভায় তাপসবাবু এবারও প্রায় তিন হাজার ভোটে পিছিয়ে ছিলেন। সেই রাগ থেকেও তিনি এই ধরণের প্ররোচনামূলক মন্তব্য করতে পারেন বলে মনে করছেন অনেকে। আবার অনেকের মতে, নির্বাচনের আগে থেকে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জেরবার তাপসবাবু নিজের প্রভাব প্রতিষ্ঠা করতেই জেনে-বুঝে কর্মীদের এমনটা বলেছেন।

তবে তাপসবাবু যে কারণেই এমনটা বলে থাকুন না কেন, জেলা নেতৃত্ব তাঁর পাশে নেই। নদিয়া জেলা তৃণমূল কংগ্রেসের কার্যকরী সভাপতি অজয় দে বলেন, ‘‘দল বিষয়টি দেখছে। ওঁকে জবাবদিহিও করা হয়েছে। এটা বলতে পারি যে এই ধরণের মন্তব্য অভিপ্রেত নয়। সমর্থনযোগ্য নয়।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement