চুরি যাওয়া সেই বিগ্রহ। —নিজস্ব চিত্র।
ভক্ত সেজে ভগবানকে নিয়ে চম্পট দিল চোর! মঙ্গলবার দুপুরে ঘটনাটি ঘটেছে নবদ্বীপের শতাব্দী প্রাচীন শ্যামসুন্দর জিউয়ের আখড়ায়। ‘শ্যামসুন্দর জিউ’ নামে ভক্তদের কাছে পরিচিত ওই বিগ্রহ আড়াইশো বছরেরও বেশি প্রাচীন বলে জানা গিয়েছে। এমন ঘটনায় এলাকার মানুষ ফুঁসছেন।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, মঙ্গলবার সকাল ন’টা নাগাদ বছর বাইশের এক যুবক নিজেকে বৈষ্ণব ভক্ত বলে দাবি করে ওই আখড়ায় ঢোকে। সে তার নাম বলেছিল শ্যাম দাস। বাড়ি মেদিনীপুর। মঙ্গলবার সে আর সকলের সঙ্গে দুপুরের প্রসাদ খেয়ে ওই বিগ্রহের ঘরের সামনে সে বিশ্রাম নিচ্ছিল। ওই ঘরের দরজা তালাবন্ধ থাকলেও চাবি রাখা ছিল দরজার পাশেই। এরপর সন্ধ্যা পুজোর প্রস্তুতির জন্য মন্দিরের ঘরে ঢুকতেই সেবাইত দেখেন, সিংহাসনে অনান্য বিগ্রহ থাকলেও শ্যামসুন্দরের বিগ্রহ নেই। সেই সঙ্গে উধাও মেদিনীপুর থেকে আসা সেই ভক্ত। ঘটনার পরেই মন্দির কর্তৃপক্ষের তরফে নবদ্বীপ থানায় চুরির অভিযোগ দায়ের করা হয়। পুলিশ ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে।
বিগ্রহ চুরির খবর ছড়িয়ে পড়তেই এলাকার মানুষ ভিড় জমাতে থাকেন শ্যামসুন্দরের আখড়ায়। তাঁদের ক্ষোভ, নিতান্ত সাদামাটা আখড়ায় বছরের পর বছর ওই বিগ্রহ নিরাপদেই ছিল। কিন্তু কয়েক বছর ধরে আখড়ার সেবা-পুজোর দায়িত্বভার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আখড়ার জৌলুস বেড়েছে, বেড়েছে নিত্য নতুন লোকের আনাগোনাও। তারই পরিণতিতে এমন ঘটনা কি না তা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। ওই আখড়া লাগোয়া এলাকার বাসিন্দা ছবি চক্রবর্তী, অনিমা সাহা, মিনতি হালদারদের কথায়, ‘‘একজন অচেনা মানুষকে হঠাৎ করে মন্দিরে থাকার অনুমতি দেওয়া হল কেন? কেন তার পরিচয় যাচাই করা হল না? কী উদ্দেশে ওই যুবক এখানে এসেছিলেন সেটাও কেউ জানতে চাইলেন না!’’
যদিও এসব প্রশ্নের সদুত্তর শ্যামসুন্দর জিউয়ের আখড়ার বর্তমান সেবাইত মুকুন্দ দাসের কাছে মেলেনি। তিনি বলেন, “যে কোনও মন্দিরে বৈষ্ণব ভক্ত এসে থাকতে চাইলে তাঁকে তিন দিন থাকতে দেওয়া হয়। এটাই নিয়ম। তাই ওঁকেও থাকতে দেওয়া হয়েছিল।’’ তিনি জানান, মঙ্গলবার নয়, দিন চারেক আগে শ্যামদাস নবদ্বীপে আসে। সে কৃষ্ণ বলরাম মন্দিরে এই ক’দিন ছিল। মঙ্গলবার কখন সে এই মঠে চলে এসেছে তা তিনি জানেন না।
গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের সম্পাদক অদ্বৈত দাস বাবাজি জানান, যে কোনও মঠে কাউকে থাকতে দেওয়ার আগে তাঁর বিস্তারিত পরিচয় জানা হয়। সেই ব্যক্তি কোন মঠ থেকে আসছেন, কোন ধারার অনুসারি, কে তাঁর গুরু সব জানা হয়। কিন্তু ওই আখড়ায় যে ভাবে ওই যুবক নিজেকে ভক্ত পরিচয় দিয়ে উঠেছিলেন সে ভাবে কাউকে থাকতে দেওয়া হয় বলে তাঁর জানা নেই।
বহু প্রাচীন ওই বিগ্রহ কবে থেকে পুজো হচ্ছে তা নিয়ে কোন পাথুরে প্রমাণ নেই। নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেব বলেন, “ যেটুকু জানা গিয়েছে, ওই বিগ্রহ আগে জেলেরা পুজো করতেন। পরে সেটি তাঁরা মাধবদাসের হাতে তুলে দেন। এই মাধব দাস ছিলেন বৈষ্ণব সাধক শুকদেব মহারাজের শিষ্য। পরবর্তী কালে একটি ট্রাস্টকে মন্দিরের সেবা-পুজোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। অনুমানহয়, ওই বিগ্রহটি প্রায় আড়াইশো বছরের প্রাচীন।” ওই আখড়া এবং বিগ্রহের দায়িত্বপ্রাপ্ত শ্রীশ্রী শ্যামসুন্দর ও গোপাল জিউ ট্রাস্টের একমাত্র জীবিত সদস্য নিখিল অধিকারি পুলিশের কাছে বিগ্রহ চুরির ঘটনায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। নিখিলবাবু বলেন, “সরকারি ভাবে এই প্রাচীন বৈষ্ণব আখড়া রক্ষার ব্যবস্থা করা হোক।’’
নবদ্বীপের আইসি তপনকুমার মিশ্র বলেন, “ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে। শহরে পুলিশি টহলদারিও বাড়ানো হয়েছে।’’