স্বাধীনতা আন্দোলনের তহবিল সংগ্রহে বহরমমপুরে এসে কৃষ্ণনাথ কলেজে ছাত্র-শিক্ষকদের সামনে ভাষণ দেন মহাত্মা গাঁধী। কাশিমবাজার মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীকে পাশে বসিয়ে সেই ভাষণে তিনি জানিয়েছিলেন, সারা বিশ্বে শ্রেষ্ঠ দানবীর পরিবার হিসাবে কাশিমবাজার রাজবাড়ির জুড়ি নেই। সেই রাজবাড়ির রাজপুত্র শ্রীশচন্দ্র নন্দীর বিয়ে বলে কথা! সেই রাজকীয় বিয়ের ভোজের মেনু কী হবে, তা সহজেই অনুমেয়। ভুল হল। সহজে অনুমেয় নয়!
রাজবাড়ির সামনে শামিয়ানা টাঙানো হয়েছে। সকাল সন্ধ্যা সিংহদুয়ারে প্রতিদিনের সানাইবাদানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিয়ের সানাই। রাজুপুত্রের বিয়েতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রাজারাজড়ারা এসেছেন। আমন্ত্রিতদের চমক দেওয়ার জন্য সেকালের বিয়ের ভোজের মেনু নিয়ে একটু রহস্য ঘেরা গোপনীয়তা থাকত। আমন্ত্রিতরা ইতিউতি উঁকি দিয়ে ভোজের আগাম খাদ্য তালিকা জানার চেষ্টা করতেন। অনেক প্রথাভাঙার উত্তরাধিকারে সমৃদ্ধ কাশিমবাজার রাজপরিবারের রাজকুমার শ্রীশচন্দ্র নন্দীর বিয়ের ভোজেও পূর্বের প্রথা ভাঙেন মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী। ১০৩ বছর আগে রাজকীয় ভোজ খেতে বসার আগেই আমন্ত্রিতদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল ছাপানো খাদ্য তালিকা। তা দেখে আমন্ত্রিত রাজা-জমিদারদের আক্কেল গুড়ুম!
সংস্কৃত ও বাংলায় লেখা ওই খাদ্য তালিকায় ছিল ২০৯ রকমের পদ। তালিকার চার নম্বরে আছে মাতৃধটধাবনম (মাছের পোলাও), ১১ নম্বরে আছে স্থলকমলপুষ্প পলায়নম (গোলাপ ফুলের পোলাও), ১৬ নম্বরে আছে দগ্ধবিগুনবটিকা (বেগুনপোড়ার বড়া), ৭৫ নম্বরে আছে দ্বিস্বাদ কবজিকা (কইমাছের একধারে ঝোল ও একধারে অম্বল), ১১৩ নম্বরে আছে শুষ্ককলায়াশ্যব্যঞ্জনচৌর্য্যং (মটরসুটির কচুরি)। ওই তালিকায় আছে পাঁচ রকমের সরবত, ১৩ রকমের মোরব্বা। রাজকীয় ভোজ থেকে বাদ যায়নি ‘তুচ্ছ’ ডুমুর ও কাঁকড়া।
রাজকীয় খাদ্য তালিকার ৯১ নম্বরে আছে কুলীরকশূল্যং (কাঁকড়ার চিনে কাবাব), ১০৫ নম্বরে আছে ওড়ুম্বুর কল্পতরু (ডুমুরের কল্পতরু)। মহারাজার ছেলের বিয়ের ভোজের পাতে বেগুনপোড়া আর ডুমুরের পদ ঠাঁই পেয়েছিল। সেকালে গ্রামের দিকের বিয়েতে বেগুনের মালিশ, কাঁঠালের মালিশ বাদ যেত না। ওই সব পদের চাহিদা ছিল তুঙ্গে। ভোজের পাতের সামনে দিয়ে এক হাতে বালতি ও অন্য হাতে ডাব্বা হাতা নিয়ে ‘খাট্টা! খাট্টা!’ বলে আওয়াজ করে পরিবেশক ঘুরতেন। তেঁতুল বা আম দিয়েতৈরি ‘খাট্টা’ ডাল মুখের স্বাদ বদলাতে ভোজবাড়ির আমন্ত্রিতদের খুব প্রিয় ছিল।