সৈয়দপুর-২

লাঠির ডগায় মুন্ডু গেঁথে ফিরে গেল তারা

ভুলে যাওয়া সময়ের ডায়েরিতে হলদে পাতা ওড়ে, তাতে শুকনো রক্তের দাগ। এক সময়ে হইচই ফেলে দেওয়া খুন-জখমের ইতিবৃত্ত চুপ করে থাকে পুলিশ ফাইলে। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন এক দিন সংবাদের কেন্দ্রে চলে আসা আত্মীয়-পরিজন। কিনারা হয়েছে সব রহস্যের? ভুলে কি গিয়েছে সবাই? খোঁজ নিচ্ছে আনন্দবাজার।বটগাছটার গুঁড়িতে অনেক দিন পর্যন্ত গাঁথা ছিল তিরগুলো। ছেলেবেলায় দেখা, ভীষ্মের শরশয্যার ছবিটা মনে পড়িয়ে দিত। তার শরীরের বাড়বাড়ন্তে অজস্র তিরের সেই ক্ষত আপন নিয়মে ঢেকে গিয়েছে। পদ্মাপাড়ে সীমান্ত রচনা করে আজও ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই গাছ।

Advertisement

অনল আবেদিন

শেষ আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০২:১৩
Share:

বটগাছটার গুঁড়িতে অনেক দিন পর্যন্ত গাঁথা ছিল তিরগুলো। ছেলেবেলায় দেখা, ভীষ্মের শরশয্যার ছবিটা মনে পড়িয়ে দিত। তার শরীরের বাড়বাড়ন্তে অজস্র তিরের সেই ক্ষত আপন নিয়মে ঢেকে গিয়েছে। পদ্মাপাড়ে সীমান্ত রচনা করে আজও ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই গাছ। আর একই রকম রয়ে গিয়েছে গ্রামটাও, সৈয়দপুর।

Advertisement

সেই বটবৃক্ষের পড়শি জহুরা বেওয়া-ও রয়েছেন। আর মনে রেখে দিয়েছেন, পাক্কা আড়াই দশক আগের, তিনটে ঘণ্টা।

১৯৮৭ সালের ৩১ মে-র দুপুর থেকে সন্ধ্যা, সেই তিন ঘণ্টা— তাঁর চোখের সামনেই তো ‘তাজা’ ছেলেটাকে মেরে তার কাটা মুন্ডুটা লাঠির ডগায় গেঁথে নাচানাচি করছিল। চোখ বুঁজলে দুপুরটা বুজকরি কেটে ভেসে ওঠে। ছেলেটার নাম লাল মহম্মদ শেখ। ছিন্ন দেহটায় কী কোনও পরিচয় ছিল? নাকি ধর থেকে মুন্ডু আলাদা হয়ে গেলে আর কোনও পরিচয়ই থাকে না? জহুরা অনেক দিন একা একা বসে এই কথাটা ভাবার চেষ্টা করেছেন।

Advertisement

পুড়িয়ে, কুপিয়ে খুন তো করা হয়েছিল আরও অন্তত দু’জনকে, কিন্তু লালের ওই ছিন্ন মস্তক...নাঃ আর ভাবতে পারেন না জহুরা।

বলছেন, ‘‘লাল মহম্মদের পরে খুন হল আনারুল ইসলাম (২০) আর কাইমুদ্দিন শেখ (৪২)। তিন তিনটে লাশের কথা কি ভোলা যায়! ভয়ঙ্কর। ভাবলেই কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে গো বাবা, মাথা ঘুরপাক খায়!’’

ওরা সবাই সিপিএম করত। বলছেন গ্রামের লোকেরা। ঘটনার মাস কয়েক আগে ‘টুপ’ করে দল বদলে কংগ্রেসে ভিড়েছিল তিন জনে। গ্রামের প্রবীণ মানুষটা মনে করছেন, ‘‘দল বদলের পর থেকেই লাল মহম্মদদের নামে চুরি-ছিনতাইয়ের একের পর এক অভিযোগ উঠতে থাকে। ওই দিন সকালেও গ্রামের একটা ছেলের কাছ থেকে সাইকেল কেড়ে নিয়েছিল বলে শুনেছিলাম। গ্রামে বসল সালিশি।’’

স্মৃতিটা উস্কে দিচ্ছেন লালের মা জহুরা বেওয়া—‘‘ছেলেকে কী করে মারল শুনবেন, সালিশির বদলে পাশের গ্রাম থেকে কাতারে কাতারে মানুষ এল, লাঠি, বল্লম, টাঙি কী ছিল না তাদের হাতে। ছেলেটা মাজু শেখের টালির বাড়িতে পালিয়ে গিয়েছিল। টালিতে কী প্রাণ আটকায় বাবা!’’

সেই রক্তাক্ত স্মৃতিটা শেষ করছেন লালের বউদি নবিয়া বিবি, ‘‘খুনিদের পা ধরে জান ভিক্ষা চাইলাম, জানেন। তবুও তারা চালার টালি তুলে ঘরের ভিতরে উঁকি দিল, আর দেখল ভিতরে গুটিসুটি মেরে বসে আছে আমার দেওরটা। খুন করে ধড় থেকে মাথাটা কেমন আলাদা করে ফেলল গো...।’’

সেই শুকনো রক্তের দাগ ধরে ধরে সৈয়দপুর গ্রামে পৌঁছে জানা গেল, তখন সে গ্রাম ছিল ভগবানগোলা থানার এক্তিয়ারে। সমাজবাদী পার্টির প্রাক্তন বিধায়ক মজিবর রহমান সে বছর বিধানসভায় দাঁড়িয়েছিলেন ভগবানগোলা থেকে। তবে সমাজবাদি-টাদি নয়, এক্কেবারে কংগ্রেসের হয়ে।

লালেদের খুন করতে এলে ভয়ে তারা সদলবল তাই ঢুকে পড়েছিল মজিবরের বাড়িতে। প্রত্যক্ষদর্শী সায়ামন শেখ তখন ১২ বছরের বালক। সায়ামন বলেন, ‘‘খড়ের আঁটি কেরোসিনে ভিজিয়ে আগুন ধরিয়ে জানালা দিয়ে ঘরের ভিতরে ছুড়তে থাকে ওই লোকগুলো।’’ আগুনের হলকা সইতে পারেনি তারা। জানালার শিক বেঁকিয়ে বের হয়ে হাতজোড় করে কাঁদতে কাঁদতে তারা বলেছিল, ‘‘তোমাদের দলেই ফিরে যাব দাদা, ঠিক দেখো। দোহাই, মেরো না।’’ তবে সে কথা শোনার মতো অবস্থায় কি ছিল তারা? ঝপাঝপ পড়েছিল টাঙির কোপ। তারপর অবাধে লুঠ। চাল, গম, টাকা, ঘড়ি, এমনকী গোয়ালের গরু আর খামারের কোণ ঘেঁষে ছুটে যাওয়া ঝলমলে মোরগটাও।

মজিবরদের বাড়িতে ছিল সরকারি লাইসেন্সের রাইফেল। লুঠেরাদের আটকাতে মজিবরের বাবা আব্দুল গফুর রাইফেল নিয়ে ছাদে উঠতে গিয়েছিল। শ্বশুরকে মানা করতে যাওয়ার আগেই ওই দল থেকে দু’টো লোক এসে ছিনিয়ে নিয়েছিল বছর খানেকের ছোট্ট ছেলেটাকে। হাবিবা বলছেন, ‘‘ছেলের মাথাটা নীচের দিকে ঝুলিয়ে হুমকি দিচ্ছিল জানেন? রাইফেল তাদের হাতে তুলে না দিলে ছেলেটাকে গেঁথে ফেলবে।’’

সেই দুপুরে টুকরো টুকরো এমনই অজস্র রক্ত-গল্প নিয়ে এখনও জেগে আছে সৈয়দপুর। পুলিশের খাতায় তিনটে খুন, আর চোদ্দোটা বডসড় জখম— ব্যাস! আর সেদিনের আক্রমণকারীরা লাঠির ডগায় ছেঁড়া মুন্ডু নিয়ে ফিরে গিয়েছিল হাঁটতে হাঁটতে। সেদিনের ঘটনায় অভিযুক্তদের তালিকায় ছিল ১৪০ জনের নাম। তালিকার প্রথম দিকে ছিলেন সিপিএমের বর্তমান ভগবানগোলা জোনাল কমিটির সম্পাদক, তথা দলের জেলা কমিটির সদস্য মহসিন আলি ও আখরিগঞ্জ লোকাল কমিটির সদস্য আমিনুল ইসলাম। মহসিন আলির শ্বশুর আমিনুল ইসলাম ঘটনার সময় স্থানীয় খড়িবোনা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান ছিলেন। ওই খুনের ঘটনার প্রতিবাদে ওই গ্রামে গিয়ে মৃতের পরিবারের লোকজনদের সুবিচারের আশ্বাস দিয়েছিলেন কংগ্রেসের নেতা প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি, মানস ভুইঞা ও প্রাক্তন মন্ত্রী আব্দুস সাত্তার। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোও বিচারই পায়নি মৃতের পরিবার। মহসিন আলি ও আমিনুল ইসলাম দু’ জনেই বলেন, ‘‘চার বছরের মধ্যে আদালতে ওই মামলার চার্জশিট জমা দিতে পারেনি পুলিশ। সেই কারণে ওই মামলা থেকে আমরা বেকসুর খালাস পেয়েছি।’’

আইনজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘসূত্রিতার ফলে হারিয়ে যায় বহু মামলাই। নিঃশব্দে কাঁদে বিচার। তিন বছরের মধ্যে মামলার চার্জশিট দিতে না পারায় অনেক সময় তাই খালাস পেয়ে গিয়েছে অভিযুক্তেরা। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। সৈয়দপুর তাই সেই দুপুরের ছিন্নমস্তকের স্মৃতি হাতড়ে
বেঁচে রয়েছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement