অনুশীলনে মগ্ন। ছবি: বিশ্বজিৎ রাউত।
পর্যাপ্ত পরিকাঠামোর অভাব। নেই তালিকা করতে বসলে অত সহজে শেষ হবে না। তারপরেও থেমে নেই ডোমকলের খেলাধুলা। শহরের আনাচে কানাচে পুরুষ ও মহিলারা নামছে ব্যাট- বল হাতে।
কখনও মহকুমা স্তরে সংগঠিতভাবে আবার কখনও স্থানীয় ক্লাবের উদ্যোগে চলছে খেলা। জেলার অন্যতম পিছিয়ে পড়া এই এলাকায় পুরুষরা তো বটেই এমনকী মহিলারাও মাঠে নামছেন। ডোমকল এখন জেলা মহিলা ক্রিকেট দলের ‘সাপ্লাই লাইন’ হিসেবে পরিচিত। কাবাডি ও খো-খো খেলাতেও এখানকার মেয়েরা রাজ্য স্তরে দাপাচ্ছে। আর ফুটবল ডোমকলের প্রাণ। মহকুমার বিভিন্ন প্রান্তে বছরভর চলছে ফুটবল। মহকুমা লিগ ছাড়াও কামদাকিঙ্কর কাপ, পুলিশের তরফে আয়জিত ফুটবল। এমনকী রাত হ্যালোজেনের আলোতেও চলে ফুটবল, ভলিবল ও ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগীতা। অনেকক্ষেত্রে এই সব প্রতিযোগীতায় জেলার বাইরেরও অনেক খেলোয়াড় আসেন। আর খেলা হলেই দর্শক আসন টইটম্বুর।
অন্যদিকে খেলা নিয়ে স্থানীয় মানুষের মত প্রশাসনেরও উৎসাহের খামতি নেই। প্রশাসনের সহযোগিতায় মাথা গোঁজার মত একটা ঠাঁই হয়েছে মহকুমা ক্রীড়া সংস্থার। তাছাড়াও প্রশাসনের পক্ষে বিভিন্ন সময়ে আয়োজন করা হয় ফুটবল বা ক্রিকেট প্রতিযোগীতা। খেলার উন্নতির জন্য কখনও জায়গা, কখনও সরঞ্জাম বা আর্থিকভাবেও সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে পুলিশ ও প্রশাসন। খেলার মাঠেও নেমে পড়েন প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা। মিশে যায় রাজনৈতিকভাবে আড়াআড়িভাবে ভাগ হওয়া মানুষ।
এক সময় রাজনৈতিক হানাহানিতে উত্তপ্ত হয়ে থাকত ডোমকল। আর এখন সে সব পাশে সরিয়ে খেলা মানেই ডোমকল। সিএবি থেকে আইএফএ- এক ডাকে চেনে মুর্শিদাবাদের এই প্রান্তিক মহকুমাকে। জেলার সিনিয়র থেকে জুনিয়র, এমনকী মহিলা ক্রিকেটেও অনেক মুখ এই শহরের। হাজারও প্রতিকূলতা থাকলেও জেলা ফুটবলেও অংশ নিচ্ছে ডোমকল। মহকুমা ক্রীড়া সংস্থার কর্তা ধীমান দাস বলেন, ‘‘খেলা এলাকার সামাজিক অবস্থার কতটা পরিবর্তন ঘটাতে পারে ডোমকলকে না দেখলে তা বোঝা যাবে না।’’ ডোমকলের প্রাক্তন এসডিপিও অরিজিৎ সিংহ বর্তমানে দক্ষিন ২৪ পরগনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গ্রামীন পূর্ব)। তাঁর কথায়, ‘‘ডোমকল ছেড়ে এলেও ডোমকলের খেলা ভুলতে পারিনি। ডোমকলের মানুষ খেলার জন্য অনেক কিছু করতে পারে। আমরা ২০১৪ সালে রাতের পুলিশ ফুটবল আয়োজন করে সেটা বুঝতে পেরেছি। সেই আবেগ উন্মাদনা কোনওদিন ভুলব না। আর ওখানে মহিলা ক্রিকেট একটা বিপ্লব।’’
এক সময় মহিলাদের ঘর থেকে বার হওয়া নিয়ে আপত্তি ছিল পরিবারের। সমাজের চোখ রাঙানীতে খেলা দুরের কথা দর্শকাসনে থাকাও কঠিন ছিল। সেখানে মহিলারা ব্যাট হাতে মাঠে। এখন শহরের চেনা ছবি মহিলা ক্রিকেট।
উন্মাদনা, আবেগ থাকলেও খেলার উপযুক্ত পরিকাঠামো অবশ্য নেই। প্রশিক্ষক বলতে ডোমকল ভবতারণ স্কুলের ক্রীড়া শিক্ষক মিহির দাস। সহযোগী মহকুমা হাসপাতালের চিকিৎসক বরুণ বিশ্বাস, আসাবুল মল্লিক, তৌফিক আনোয়ার-সহ জনাকয়েক বেকার যুবক। তবে খেলার জন্য হাত বাড়িয়েছেন এলাকার বেশ কিছু দরদী মানুষ। শহরের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী সাজ্জাদ আলি, ঠিকাদার গোলাম মোর্তজা, মুন্না থেকে চিকিৎসক, পুলিশ কর্তা সকলেই। কেউ পোশাক, কেউ জুতো কেউ আবার অনুশীলনের টিফিন দিয়ে দাঁড়িয়েছেন পাশে। চিকিৎসক বরুণ বিশ্বাস বলেন, ‘‘ডোমকল নিয়ে অনেক আতঙ্কের কথা শুনেছিলাম। কিন্তু এখানে এখনও প্রাণখোলা মানুষ আছেন। ভাল কিছুকে তাঁরা সমর্থন করেন।’’ এখনও মহকুমা শহরে ষ্টেডিয়াম তো দূরের কথা, ভাল একটা মাঠও নেই। নেই প্রশিক্ষক থেকে সরঞ্জাম বা জিম। তার মাঝেও নিজেদের উদ্যোগে ডোমকল স্পোর্টিং ক্লাব কচিকাচেদের নিয়ে শুরু করেছে ফুটবল প্রশিক্ষণ শিবির। আর্থিক অনটনের মধ্যেও মহকুমা ক্রীড়া সংস্থা কোনওক্রমে চালিয়ে যাচ্ছে মহিলা ক্রিকেট। ডোমকল ব্যাডমিন্টন অ্যসোসিয়েশন চাঁদা তুলে অস্থায়ীভাবে কাঠের ষ্টেডিয়াম তৈরি করে কিছুদিন আগে আয়োজন করে রাজ্য স্তরের প্রতিযোগিতা। ডোমকল আজাদ ক্লাবের সম্পাদক তজিমুদ্দিন খাঁন বলেন, ‘‘প্রশিক্ষক বা ভালো ষ্টেডিয়াম নেই। নেই ভাল মাঠ। তার পরেও এই শহরে খেলাপ্রেমী মানুষের অভাব নেই। সরকারী সহযোগিতা পেলে ডোমকল অনেককিছু দিতে পারবে।’’ ডোমকলের মহকুমা শাসক পুস্পেন্দু মিত্র বলেন, ‘‘ডোমকলে না এলে বুঝতে পারতাম না, এখানকার মানুষ কতটা খেলা পাগল। এখানে খেলা মানেই বিনোদন, খেলা মানেই মিলনক্ষেত্র।’’
তবে ক্লাবগুলি ভুগছে অর্থকষ্টে। ডোমকল স্পোটিং ক্লাবের সম্পাদক দেবাংশু সরকারের দাবি, ‘‘ছোটদের ফুটবল কোচিং করাতে গিয়ে মুশকিলে পড়তে হয়েছে। নামী প্রশিক্ষককে পারিশ্রমিক দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই।” খোদ মহকুমা ক্রীড়া সংস্থাও আর্থিক সঙ্কটে। মহকুমার রেফারি আম্পায়ার জাজেস অ্যসোসিয়েশনের সম্পাদক সরিফুল ইসলাম বলেন, ‘‘আর্থিক সঙ্কটের জন্য রেফারি আম্পায়ারদের সামান্য সান্মানিকও দিতে পারছি না আমরা। এভাবে চলতে থাকলে মুখ থুবড়ে পড়বে খেলা।’’