খবর বেরোতেই মাটি কাটা দেখতে হাজির কর্তারা। মঙ্গলবার সুঁটিয়া বিলে। নিজস্ব চিত্র।
চাপড়ার মানুষ জানেন, রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদল মাটি কারবারিদের স্পর্শ করতে পারে না। যখন যে-ই ক্ষমতায় থাক, এদের ব্যবসা চলে স্বচ্ছন্দ গতিতে। কারণ রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি পুলিশ-প্রশাসনের ভিতরে এদের অবাধ বিচরণ। থানার ‘ডাকবাবু’ (যিনি তোলাবাজির টাকা সংগ্রহের দায়িত্বে থাকেন বলে অভিযোগ) থেকে শুরু করে ছোট-বড় নেতার হাতে প্রতি মাসে টাকা পৌঁছে যায়। বিরোধীরাও আশ্চর্যজনক ভাবে চুপ। হয় এ বিষয়ে তাদের কোনও উৎসাহ নেই অথবা প্রতিবাদ করার মত শক্তি-সাহস কিছুই নেই। আর সেই সুযোগে বিঘার পর বিঘা জমির মাটি পাচার হয়ে যাচ্ছে।
সুঁটিয়ার পাশের গ্রাম ফুলবাড়ি। এই গ্রামের উপর দিয়েও চলে গিয়েছে বিল। সুঁটিয়ার রাজু, তাপস, মিঠুন, মিলনদের পাশপাশি এই ফুলবাড়ির মনিরুলের নামও মাটি কারবারি হিসাবে যথেষ্ট পরিচিত। স্থানীয় সূত্রের খবর, রাজ্যের শাসক দলের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত এই মনিরুলের একাধিক ট্রাক্টর আছে, যেগুলি শুধু মাত্র মাটি পাচারে ব্যবহৃত হয়। মূলত ফুলবাড়ি এলাকায় বিলের মাটি কেটেই তার ফুলে-ফেঁপে ওঠা। তবে চাপড়া ব্লকে মাটি পাচারকারীর সংখ্যা নেহাত কম নয়। বর্ষার ক’টা দিন বাদ দিলে প্রায় সারা বছরই এদের দাপট চলে। বিশেষ করে যে সমস্ত এলাকায় ইটভাটা আছে সেখানে এদের দৌরাত্ম্য বেশি। চাপড়ার বালিয়াডাঙা, হুদো, বৃত্তিহুদা, ন’মাইল, পুকুরিয়া এলাকায় মোটা টাকা দিয়ে চাষের জমি কিনে নেয় মাটি কারবারিরা। তারপর সেই যন্ত্র দিয়ে কাটা মাটি ট্রাক্টর বোঝাই হয়ে পাচার হয়।
আবার হাঁটরা, মহেশনগর, বৃত্তিহুদা, পুকুরিয়ায় জলঙ্গির পাড় কেটে মাটি পাচার হয়।
স্থানীয় মানুষ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গ্রামের রাস্তা দিয়ে মাটি পাচার হতে দেখেন। শুধু পুলিশ-প্রশাসন দেখতে পায় না বলে অভিযোগ। কেন?
মাটি কারবারিদের কাছ থেকেই মেলে সোজাসাপ্টা জবাব— “পুলিশ দেখবে কী করে? থানায় মান্থলি করা আছে না!” ‘মান্থলি’ বলতে বোঝায় মাস-চুক্তি। কারবারিদের দাবি, যে সব ট্রাক্টর মাটি পাচারের কাজে লাগে সেগুলির প্রত্যেকটির নম্বর ও ট্রাক্টর পিছু এক হাজার টাকা করে জমা রাখতে হয় পুলিশের কাছে। থানার ডাকবাবু মাসের প্রথমে সেই সমস্ত সংগ্রহ করে নেন। তবে এক বার ‘মান্থলি’ দিলে সারা মাস নিশ্চিন্তি।
তা হলে মাঝে-মধ্যে পুলিশ যে ‘অভিযান’ চালিয়ে ট্রাক্টর ও মাটি কাটার যন্ত্র আটক করে? গ্রেফতার করে ট্রাক্টর চালকদের?
মাটি পাচারে জড়িতদের দাবি, সে আবার ‘অন্য গল্প’। অনেক সময়ে এলাকা থেকে জেলার পুলিশ কর্তাদের কাছে অভিযোগ জমা পড়ে বা তাঁরা নিজস্ব সূত্র মারফত জানতে পেরে থানার উপরে চাপ তৈরি করেন। কখনও আবার মান্থলির মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার পরেও টাকা না দিয়ে কেউ মাটি পাচার করতে থাকলে বা অন্য এলাকার ট্রাক্টর মাটি নিতে চলে এলে পুলিশের ‘অভিযান’ হয়। কখনও কখনও মাত্রাতিরিক্ত মাটি পাচার হলেও পুলিশ আচমকা হানা দেয়, এমন অভিজ্ঞতাও রয়েছে পাচারকারীদের।
বৃষ্টি তেমন না হলেও বর্ষা এসে যাওয়ায় মাটি পাচার এই মুহূর্তে অনেকটাই বন্ধ আছে বলে স্থানীয় ভাবে জানা গিয়েছে। তবে তার মধ্যেও সুঁটিয়া, ফুলবাড়ি এলাকায় বিলের মাটি কেটে বেশি দামে পাচার হচ্ছে, যার সঙ্গে সরাসরি নাম জড়াচ্ছে তৃণমূলের স্থানীয় নেতাদের। এই এলাকাতেই যুব তৃণমূলের প্রাক্তন ব্লক সভাপতি শুকদেব ব্রহ্মের বাড়ি। যদিও তাঁর দাবি, “আমার এলাকায় মাটি পাচার হয় না। দিন কয়েক আগে বিলের জমি থেকে মাটি কাটা শুরু হয়েছিল। আমি নিজে পুলিশ ডেকে দাঁড়িয়ে থেকে বন্ধ করিয়েছি। কয়েক জনকে গ্রেফতারও হয়েছে।” বিজেপি-র ১৮ জেলা পরিষদ মণ্ডল কমিটির সভাপতি দেবেশ ঘোষের পাল্টা দাবি, “শুকদেবের লোকজনই যে মাটি কাটছে, এ তো এলাকার বাচ্চা ছেলেও জানে!”