চলছে মাটি-লুঠ। —ফাইল চিত্র।
পৌষের সঙ্গে কি সর্বনাশের সত্যিই কোনও সম্পর্ক আছে? নদীপাড়ের বাসিন্দারা বলছেন, ‘‘আছে। পৌষেই তো মাটিখেকোরা উঠেপড়ে লাগে। পাড় থেকে মাটি গেলে ওরা। আর সেই পথ ধরেই বর্ষায় ভরা নদী গিলে খায় খেত-ঘর-বাড়ি।’’
তবে কোথাও কোথাও শেষ কার্তিকেও নদী পাড়ে পড়ে কোদালের কোপ। সম্প্রতি নবদ্বীপে গঙ্গা পাড়ের বাঁধের মাটি নজরে পড়েছিল মাটি কারবারিদের। নবদ্বীপের মায়াপুর-বামুনপুকুর ২ গ্রাম পঞ্চায়েতের নিদয়া গ্রামের বাঁধে মাটি কাটায় গ্রামের বাসিন্দারা ক্ষোভে ফেটে পড়েন।
গ্রামের লোকজন দল বেঁধে তাড়া করলে ট্রাক্টর, জেসিবি ফেলে পালায় দুষ্কৃতীরা। মাটি কাটার সরঞ্জাম পুলিশের হাতে তুলে দেয় গ্রামের লোকজন। জেলা পুলিশের এক কর্তার আশ্বাস, ‘‘আমরা এ ব্যাপারে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেব।’’
যা শুনে হাসছেন নদিয়ার এক যুবক। কলকাতা পুলিশের কর্মী সেই যুবক কর্মসূত্রে কলকাতায় থাকেন। গ্রামের বাড়িতে থাকেন বৃদ্ধা মা-বাবা। আর আছে রাস্তার পাশে বিঘা কয়েক খেতি জমি। সেই যুবকের অভিযোগ, তাঁর কোনও সম্মতি না নিয়ে পাশের জমির মালিক জমির মাটি বিক্রি করে দিয়েছেন মাটি ব্যবসায়ীদের। পাশের জমি কার্যত পুকুরের চেহারা নিয়েছে। তাঁর জমিতে সেচ দিলে সেই জল নেমে যাচ্ছে ঢালু জায়গায়। নিজের পরিচয় দিয়ে গোটা বিষয়টি পুলিশের কাছে জানিয়েও কোনও লাভ হয়নি।
নদিয়া-মুর্শিদাবাদে এ রকম নানা অভিযোগের অন্ত নেই। সাধারণ মানুষের অভিযোগ, ‘‘সব জেনেও পুলিশ-প্রশাসন সেই একই কথা ভাঙা রেকর্ডের মতো বাজিয়ে চলে—‘অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া হবে’। ওদের ঠিক কত মাসে বছর হয়, বলুন তো?’’
নিট ফল, কোদালের কোপে ককিয়ে ওঠে নদী। প্রতি বছর। মাটির কারবারিরা মুখের উপরে বলে দেয়, ‘ক্ষমতা থাকলে পুলিশ গাড়ি আটকে দেখাক।’ চুরি যায় নদী। রা কাড়ে না কেউ। ফি বছর শীত পড়তেই চোখের সামনে নদী লুঠ দেখে দিন শুরু করে ঘূর্ণি, মায়াকোল, ইসলামপুর।
নবদ্বীপের মতো কান্দিও মাটি কাটতে শুরু করেছিল শীত না পড়তেই। সেখানেও প্রথমে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন এলাকার লোকজন। প্রশাসনের কাছে অভিযোগও জানান তাঁরা। তার পরেই পুলিশ মাটি-সহ পুলিশ বেশ কয়েকটি গাড়ি আটক করে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, প্রতি বছরই অভিযোগ জানানোর পরে প্রশাসন একটু নড়েচড়ে বসে। তার পরে আবার যে কে সেই।
মুর্শিদাবাদের ব্রিক ফিল্ড ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন সম্পাদক আইজুদ্দিন মণ্ডল বলছেন, ‘‘নিয়ম মেনেই মাটি কাটতে বলা হয় ভাটা মালিকদের। এ বারেও তাই বলা হয়েছে। তার পরেও কেউ বেআইনি কাজ করলে প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে।’’ নদিয়ার ব্রিক ফিল্ড ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুনীল পালও বলেছেন, ‘‘আমরা বেআইনি ভাবে মাটি কাটা সমর্থন করি না।’’ তা হলে মাটি কাটছে কারা? সে প্রশ্নের অবশ্য উত্তর মেলে না।
মুর্শিদাবাদ অতিরিক্ত জেলাশাসক (ভূমি ও ভূমি সংস্কার) বিভু গোয়েল বলছেন, ‘‘আমরা সপ্তাহ দু’য়েক আগে বেআইনি ভাবে যারা মাটি কাটে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছি। সে ব্যাপারে আপস করা হবে না।’’ আর নদিয়ার জেলাশাসক সুনীল গুপ্ত বলছেন, ‘‘যে ভাবেই হোক, বেআইনি ভাবে মাটি কাটা বন্ধ করা হবে।’’
ভুক্তভোগী বলছেন, ‘‘দেখা যাক, শীতে প্রশাসনের ঘুম ভাঙে কি না!’’