গরমে আকাল ছোট মাছের, চিন্তায় ভেতো বাঙালি

তাপ ক্রমেই বাড়ছে। বৃষ্টিও নিরুদ্দেশ। কবে তার দেখা মিলবে, সদুত্তর দিতে পারছে না আবহাওয়া দফতর। বর্ষা আসতে সেই জুন। আর এ সবের জেরে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে কোপ পড়তে পারে বাঙালির ভাত পাতে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কৃষ্ণনগর ও বহরমপুর শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০১৬ ০০:৫২
Share:

খরিদ্দারের দেখা নেই। করিমপুরে। ছবি: কল্লোল প্রামাণিক।

তাপ ক্রমেই বাড়ছে। বৃষ্টিও নিরুদ্দেশ। কবে তার দেখা মিলবে, সদুত্তর দিতে পারছে না আবহাওয়া দফতর। বর্ষা আসতে সেই জুন। আর এ সবের জেরে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে কোপ পড়তে পারে বাঙালির ভাত পাতে।

Advertisement

এই গরমে ছোট মাছ যে উধাও। বাজারে যদি বা কুচো মাছের দেখা মেলে, তাতে হাত দেওয়াই দায়। চড়া দাম।

আর এ সবের জন্য দায়ী— টানা গরম ও অনাবৃষ্টি। শুকিয়ে গিয়েছে খাল-বিল। ফুটিফাটা পুকুর। নদিয়ার বাজারগুলোয় একটা বড় অংশ মাছ আসে এখান থেকেই। সেটা প্রায় বন্ধ হতে বসেছে। এই ভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে পড়বে, মনে করছেন মৎস্য দফতরের কর্তারাও।

Advertisement

প্রতি বছর এই সময় এমনিতেই স্থানীয় মাছের জোগান কম থাকে। কিন্তু এ বছর পরিস্থিতি অনেকটাই আলাদা। এপ্রিল মাসে এখনও পর্যন্ত এক দিনও বৃষ্টির দেখা মেলেনি। ফলে জেলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিরাট পরিমাণ খাল, পুকুর প্রায় শুকিয়ে গিয়েছে। এখনও পর্যন্ত যেটুকু মাছ সরবরাহ হচ্ছে, তা আসছে বিল বা বাওড় থেকে। কিন্তু সেটাও বেশি দিন সম্ভব হবে না, আশঙ্কা আধিকারিকদের।

নদিয়া জেল‌ার খালের পরিমাণ ২৭৭১ হেক্টর, বিল ও বাওড়ের পরিমাণ ১৯১২ হেক্টর, পুকুরের পরিমাণ ৬২০৮ হেক্টর ও নদীর পরিমাণ ৪১৯১ হেক্টর। গত বছর এই জেলায় মাছ উৎপাদন হয়ে ছিল ৯৮,৩৮৯ মেট্রিক টন। আর বাৎসরিক চাহিদা প্রায় ১ লক্ষ মেট্রিক টন। মৎস দফতরের কর্তাদের দাবি, উৎপাদিত মাছের মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ মাছ আসে পুকুর থেকে আর ৩৫ শতাংশ মাছ আসে বিল ও বাওড় থেকে। বাকি মাছ নদী ও খাল থেকে আসে।

মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে অনেক পুকুরেই জল তুলে নিয়ে সমস্ত মাছ ধরে ফেলা হয়। এর পর ‘পুকুর মারা’ বা পুকুর পুরোপুরি শুকিয়ে মাটিতে খোল, চুন মিশিয়ে লাঙল দিয়ে মাটি এলোমেলো করে খটখটে করে শুকিয়ে ফেলা হয়। পুকুর পুরোপুরি পরবর্তী মাছ চাষের জন্য তৈরি করার কাজটা করে ফেলা হয়। ফলে এই সময়টা বছরের অন্য সময়ের তুলনায় বাজারে স্থানীয় মাছ সরবরাহ কম থাকে।

কিন্তু এ বার পরিস্থিতি অনেকটাই খারাপ। জেলার মৎস্য দফতরের কর্তাদের দাবি, অনাবৃষ্টির ফলে বেশির ভাগ পুকুরই শুকিয়ে গিয়েছে। মাছ নেই। তার উপরে খালও শুকিয়ে যাচ্ছে। সেখান থেকেও মাছ আসছে না। ফলে এই দুই উৎস প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অর্ধেকের বেশি মাছের জোগান বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এই সময় নদীতেও তেমন মাছ মেলে না। বাকি থাকছে শুধু বিল ও বাউর। বাজারে স্থানীয় মাছ এখনও পর্যন্ত যা উঠছে তার প্রায় সবটাই এই বিল থেকে। নদিয়া জেলায় বিলগুলোতে সমবায়ের মাধ্যমে পরিকল্পিত ও বিজ্ঞানসম্মত ভাবে মাছ চাষ করা হয়। একটা বড় অংশের মাছ আসে সেখান থেকেই। যে কারণে, এখনও পর্যন্ত নদিয়ার বাজারে দেশী মাছের পুরোপুরি আকাল দেখা যায়নি। কিন্তু সেটাও কত ক্ষণ সম্ভব হবে, বুঝতে পারছেন না চাষিরাও। কারণ এই বিল ও বাউরে জল দ্রুত কমছে।

এ দিকে, জলের পরিমাণ কম থাকায় প্রবল তাপে সেই জলও গরম হয়ে যাচ্ছে। তাতে দ্রুত অক্সিজেন কমে যাচ্ছে জলের। জেলার মৎস্য আধিকারিক অমলেন্দু বর্মন বলেন, ‘‘এমনিতেই বৃষ্টি না হওয়ার জন্য বিল-বাওড়ে জল একেবারেই কমে গিয়েছে। তার উপরে প্রতিমুহুর্তে সেই জলও মাটির নীচে টেনে নিচ্ছে। জল গরম হয়ে যাওয়ায় যে ভাবে বিল-বাওড়ের জলে অক্সিজেন কমছে তাতে কয়েক দিনের মধ্যে ভাল পরিমাণ বৃষ্টি না হলে, কঠিন সমস্যায় পড়তে হবে। কারণ সে ক্ষেত্রে মাছ মরতে শুরু করবে। আর তা না হলে এক সঙ্গে সমস্ত মাছ তুলে বেচে দিতে হবে।’’

তিনি আরও বলেন, ‘‘এই মুহুর্তে বাজারে মাছের জোগান কম হওয়ায় হয়তো দামটা কিছু বেশি পড়ছে। কিন্তু বিল-বাওড়ের সব মাছ এক সঙ্গে তুলে ফেলে বেচে দিতে হলে আগামী দিনে মাছের সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে।’’ ভয়ের কারণ আছে আরও। অমলেন্দুবাবুর কথায়, ‘‘বৃষ্টি না হলে পুকুরেও সঠিক সময়ের মধ্যে মাছের পোনা ছাড়া যাবে‌ না। আর সেটা না হলে বছরে তিনবার মাছ চাষ করা যাবে না।’’ তিনি বলেন, ‘‘সাধারণত এই সময় গভীর নলকূপের মাধ্যমে পুকুর বা বিলে জল দিয়ে কিছুটা হলেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়। কিন্তু এ বার বৃষ্টি একাবারেই না হওয়ার জন্য ভূগর্ভস্থ জলস্তর এতটাই নেমে দিয়েছে যে সেটাও সম্ভব হচ্ছে না।’’ তবে বিল বা বাওড় গুলিতে এক বা দু’দিকের জলে কচুরিপানা দিয়ে ও নারকেলের পাতা ফেলে জলকে কিছুটা হলেও ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। যাতে মাছ ওই এলাকায় আশ্রয় নিতে পারে।

মাছের আকালের কথা মেনে নিচ্ছেন বাবসায়ীরাও। তাঁদের কথায়, ‘‘এখনও পযর্ন্ত যেটুকু স্থানীয় রুই, কাতলা, বাটা, চারাপোনা পাওয়া যাচ্ছে, সেটা চাহিদার তুলনায় অনেকটাই কম। ফলে দামও বাড়ছে দিন দি‌ন। বাকি মাছের চাহিদা মেটাতে হচ্ছে অন্ধ্রপ্রদেশ বা অন্যান্য জেলা থেকে মাছ এনে।’’ কৃষ্ণনগরের মাছের আড়তদার গৌতম হালদার, জয়ব্রত হালদাররা বললেন, ‘‘স্থানীয় মাছের আমদানি প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। আগে আমরা দিনে পাঁচশো কেজি স্থানীয় মাছ বেচাকেনা করলে এখন সেটা দাঁড়িয়েছে আড়াইশো কেজি। কারণ স্থানীয় মাছের আমদানি নেই।’’ গৌতমবাবু বলেন, ‘‘অন্য বছরও এই সময় মাছের আমদানি কম থাকে। কিন্তু এ বার সেটা মাত্রাছাড়া অবস্থা।’’

বহরমপুর কোর্ট বাজারের মাছ ব্যবসায়ী সুব্রত হালদার বলেন, ‘‘গরমে বড় মাছ খেতে চাইছে না কেউ। ফলে বাজারে ছোট মাছের দারুণ চাহিদা। কিন্তু আশপাশের কোনও খাল-বিলে জল নেই।’’ গরমে মাছ বেশিক্ষণ থাকছে না বলেও অভিযোগ মাছ ব্যবসায়ীদের। ফলে বড় মাছ নিয়ে আসার পর বাড়তি টাকা খরচ করে বরফ কিনে চাপা দিয়ে রাখতে হচ্ছে। তাছাড়া গরমে বড় মাছ খেতে পছন্দও করছেন না লোকজন। মাছ ব্যবসায়ী স্বপন হালদার বলেন, ‘‘বাজারে এসে সকলেই ছোট মাছের খোঁজ করছেন। কিন্তু চাইলেই বা ছোট মাছ পাব কোথায়?’’

মাছে-ভাতে বাঙালীর তাই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement