গ্রামে ঢুকল কফিনবন্দি দেহ। নিহত জওয়ানকে শেষ শ্রদ্ধা।
ফোনটা এসেছিল সকাল এগারোটা নাগাদ। শনিবার সেই ফোনটা ধরেছিলেন মা আয়েশা বেওয়া। ফোনের ও প্রান্ত থেকে ভেসে এসেছিল, ‘‘নভেম্বরে বাড়ি ফিরব।’’ নভেম্বর এখনও বেশ ক’টা দিন দূরে। তার আগেই রবিবার সন্ধেয় সাগরদিঘির বোখরা গ্রামের বাড়িতে কফিনবন্দি হয়ে ফিরল বছর পঞ্চাশের মির মতিউর রহমানের দেহ।
শনিবার বিকেলে ছত্তীসগঢ়ের বিজাপুরে মাওবাদীদের পেতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে উড়ে গিয়েছিল সিআরপিএফের একটি গাড়ি। তারপরেই শুরু হয় মাওবাদীদের গুলিবৃষ্টি। জবাব দিয়েছিল সিআরপিএফও। কিন্তু বিস্ফোরণ ও গুলিবৃষ্টিতে যে চার জওয়ান নিহত হন মির মতিউর রহমান তাঁদের অন্যতম। আসন্ন নির্বাচন উপলক্ষে ছত্তীসগঢ়ে টহলদারিতে বেরিয়ে এই বিপত্তি।
ছত্তীসগঢ়ের সিআরপিএফ দফতর থেকে রাত ৯টায় সেই খবর যখন মতিউরের স্ত্রী সুমাইয়া খালুনের কাছে যখন এসে পৌঁছয়, তিনি তখন বীরভূমের বাতাসপুর বড়সিজা গ্রামে তাঁর বাবার বাড়িতে। ততক্ষণে সাগরদিঘির বোখরা গ্রামের বাড়িতে সংবাদমাধ্যম মারফত দুঃসংবাদ পৌঁছে গিয়েছে বৃদ্ধা মা, ভাই, কাকাদের কাছে। বহরমপুরে বাড়িতে বসে এই খবর শুনেও বিশ্বাস করতে চাননি পিসিমা ছবি বিবিও। বোখরার বাড়িতে ফোন করে বার বার জানতে চেয়েছেন ভাইপো মতিউরের পোস্টিংটা ঠিক কোথায়।
মির মতিউর রহমান। —ফাইল চিত্র।
গোটা গ্রাম সেই রাতেই ভেঙে পড়ে মতিউরের বাড়ির ফালি উঠোনে। ছেলের ছবি বুকে নিয়ে সত্তরোর্ধ্ব মায়ের বুকফাটা কান্না রাতের নিস্তব্ধতাকে খান খান করে দিচ্ছে। নিশ্চিত হতে অনেকেই জানতে চেয়েছেন, ‘‘আচ্ছা, নিহতদের মধ্যে কি আমাদের মতিও আছে?’’
সেরাজুল হক ও বদরুল হক দুই ভাই। বোখরা গ্রামের সম্পন্ন গৃহস্থ পরিবার। বাপের ভিটে ছেড়ে সেরাজুল হক গ্রামেই দক্ষিণপাড়ায় জমি কিনে গড়ে তোলেন টিনের চালা দেওয়া মাটির বাড়ি। তাঁর দুই ছেলের বড় ছেলে মতিউর। ছোট ছেলে মির মনিরুল হক। মেয়ে সেবিনার বিয়ে হয়েছে কান্দির শেরপুরে। বছর পাঁচেক আগে সেরাজুল হক মারা গিয়েছেন। দুই ছেলের পরিবারকে নিয়ে বৃদ্ধা আয়েশা বেওয়ার সংসার সেই স্বামীর ভিটেতেই।
বড় ছেলে মতিউরকে সেভাবে বেকার থাকতে হয়নি। ১৯৮৮ সালে তিনি সিআরপিএফের চাকরিটা পেয়ে যান। মতিউরের বয়স তখন বড়জোর বছর কুড়ি। ১৬৮ নম্বর ব্যাটেলিয়নে বছর খানেক আগে তিনি অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব-ইনস্পেক্টর হয়েছিলেন। তার পরেই বদলি হন ছত্তীসগঢ়ে। তাঁর এক ছেলে, এক মেয়ে। মেয়ে খাদিজা পারভিন বড়। এমএ পাশ করার পরেই বিয়ে হয়েছে রঘুনাথগঞ্জের উমরপুরে। ছেলে মির সাইদুল হক মেডিক্যালে ভর্তির জন্য কোচিং নিচ্ছেন সাঁতরাগাছিতে। ইদের সময় মতিউর ছুটি নিয়ে এসেছিলেন বোখরার বাড়িতে। পরিবারের সঙ্গে কাটিয়ে গিয়েছেন বেশ কয়েক দিন।
পড়শি জসিমউদ্দিন বলছেন, “বড্ড মিশুকে ছিলেন মতিউর চাচা। তিনি সকলকে উৎসাহিত করতেন যাতে গ্রামের ছেলেরা সেনা ও আধা সেনা বাহিনীতে যোগ দেয়। তবে বছর খানেক থেকে তিনি একটু উদ্বেগে ছিলেন। বলতেন, ‘ছত্তীসগঢ় মাওবাদী উপদ্রুত এলাকা। কখন কী ঘটে, কে জানে!’ সেই অঘটনটাই ঘটে গেল!’’
মতিউরের কাকা মির বদরুক হক বলছেন, “বরাবরই ওর ঝোঁক ছিল সামরিক বাহিনীতে যাওয়ার। মাধ্যমিক পাশ করেই বিএসএফে যোগ দেওয়ার জন্য লালবাগে প্রথম লাইন দেয়। কিন্তু বয়স কম থাকায় সে বার চাকরি হয়নি। পরে যোগ দেয় সিআরপিএফে। এএসআই হওয়ার পরেই ও চলে যায় ছত্তীসগঢ়ে। বাড়িতেও সবাই তা নিয়ে আশঙ্কায় থাকত। সেই আশঙ্কাই যে সত্যি হয়ে যাবে, তা ভাবতেও পারিনি।”
রবিবার বীরভূমের বাবার বাড়ি থেকে বেলা দেড়টা নাগাদ বোখরায় এসে পৌঁছন তাঁর স্ত্রী। বিকেলে এসে পৌঁছয় ছেলেও। একে একে সমবেদনা জানাতে মতিউরের বাড়িতে যান বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও। ছত্তীসগঢ় থেকে দমদমে মতিউরের দেহ এসে পৌঁছয় রবিবার দুপুরে। সেখান থেকে সিআরপিএফ জওয়ানেরাই নিজেদের গাড়িতে করে দেহ নিয়ে গ্রামে আসে এ দিন সন্ধ্যায়।
সাংসদ অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়, বিধায়ক সুব্রত সাহা, প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন, সভাধিপতি মোশারফ হোসেন-সহ অনেকেই মতিউর রহমানের বাড়িতে যান। এ দিন মৃতের পরিবারের তরফে নেতাদের জানানো হয়, মতিউরের স্বপ্ন ছিল তাঁর একমাত্র ছেলেকে মেডিক্যালে ভর্তি করানোর। সেই স্বপ্ন যেন পূরণ হয়। সব নেতাই পরিবারের পাশে থাকার আশ্বাস দেন।