গতি-হারা দ্বারকা।
ময়ূরাক্ষী
প্রবাহ পথ: কান্দি মহকুমার প্রধান নদী ময়ূরাক্ষী ত্রিকূট পাহাড় থেকে উৎপত্তি। মশানজোর, তাঁতলই, ডিহিকোপা, রামনগর-মাহোড়া গ্রামের মধ্য দিয়ে এসে কান্দিতে প্রবেশ। তারপর আঁকাবাঁকা পথে কাওখালির কাছে দ্বারকা নদীতে এসে মিশেছে।
বর্তমান অবস্থা: নদীর দু’পারে পাড়বাঁধ নির্মাণের পর থেকেই নদীর বুক জুড়ে পলি জমে অগভীর হয়ে পড়েছে। বন্যার জলধারণ ক্ষমতা নদীর কমে গেছে।
আশঙ্কা: ছোটনাগপুর মালভূমি থেকে নেমে আসার ফলে এই নদী প্রচুর বৃষ্টির জল বয়ে আনে। স্বভাবতই এই নদী ভয়ঙ্কর বন্যাপ্রবণ।
প্রতিকার: নদীর নিম্ন অববাহিকার জল ধরে রাখার কোনও পরিকাঠামো নেই। কাজেই ছোট ছোট ‘চেক ড্যাম’ করে বৃষ্টির জল ধরে রাখতে পারলেই বন্যা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে।
দ্বারকা
প্রবাহ পথ: বিহারের মালভূমি থেকে নির্গত হয়ে বীরভূমের বিষ্ণুপুরের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এর পর পামকান্দি অঞ্চলের কাছে কান্দি মহকুমাতে প্রবেশ করেছে। বিষ্ণুপুরের কাছে দ্বারকা দু’ভাগে বিভক্ত হয়েছে। একটি শাখার নাম ঘুষকরা, অন্যটি দ্বারকা। এর পর এই নদী আঁকাবাঁকা পথে প্রবাহিত হয়ে কল্যাণপুরের কাছে গিয়ে গঙ্গায় মিলিত হয়েছে।
বর্তমান অবস্থা: দ্বারকার বেশির ভাগ স্রোত বর্তমানে ঘুষকরা নদীর পথ ধরে প্রবাহিত হচ্ছে। স্বভাবতই শুখা মরশসুমে দ্বারকাতে জল থাকছে না। বোরো চাষের জন্য নদীর বুকে শ্যালো বসিয়ে পৃথিবীর পেটের জল তুলে নিচ্ছে। নদীর বুক দখল করে চাষবাসও করা হচ্ছে।
আশঙ্কা: দ্বারকা নদীর ওপর ১০৮ মিটার দীর্ঘ দেউচা ব্যারাজ নির্মাণের পর থেকেই নদীর চরিত্র পাল্টে গিয়েছে। অববাহিকা জুড়ে প্রচুর মাটি আর জল তোলার ফলে নদীর বেঁচে থাকার স্বাভাবিক পদ্ধতি ‘ইফ্লুয়েন্ট সিপেজ’ বা ‘বেস ফ্লো’ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। নদী মৃত্যুর মুখে পতিত হয়েছে।
প্রতিকার: বেস ফ্লো-কে ঠিক রাখার জন্য নদী অববাহিকা জুড়ে ভূগর্ভস্থ জলের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার করতে হবে। বর্ষার জলকে ধরে রেখে নদীকে পুষ্ট রাখতে হবে। তার জন্য অববাহিকা জুড়ে ছোট ছোট পুকুর নির্মাণ করতে হবে।
ব্রাহ্মণী
প্রবাহ পথ: বিহারের দুধুয়া পাহাড় থেকে ব্রাহ্মণী নদীর জন্ম। পাহাড় পেরিয়ে এই নদী আঁকাবাঁকা পথ ধরে নলহাটি, রামপুরহাট হয়ে খড়গ্রামের কাছে দ্বারকা নদীতে মিশেছে। এই নদীর এক উল্লেখযোগ্য উপনদী হল গামারি।
বর্তমান অবস্থা: আজ থেকে তিন দশক আগেও ব্রাহ্মণী নদীর কান্দি মহকুমাতে যথেষ্ট গুরুত্ব ছিল। এখন শুখা মরসুমে এই নদীটি নালার মতো। নদীকে দখল করে এখানে চাষবাস শুরু হয়েছে। নদীর পারে যে পাড়বাঁধ রয়েছে, তার অবস্থা খুবই খারাপ। কোথাও কোথাও পাড়বাঁধের উপরেই বসতি স্থাপন হয়েছে।
আশঙ্কা: এই নদীর বর্তমান অবস্থা খুব খারাপ। বন্যার নিয়ন্ত্রণের জন্য যে পাড়বাঁধ রয়েছে, তা যে কোনও সময়ে ভেঙে পড়তে পারে। যদি বর্ষাতে জলের পরিমাণ বেড়ে যায়, এই নদীর পাড়বাঁধ ভেঙে গেলে ৫০ হাজারেরও বেশি পরিবারের সলিল-সমাধি হতে পারে।
প্রতিকার: নদীতে অবশ্যই ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন। এ ছাড়াও নদীবাঁধের সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন। যাতে নদীবাঁধ বন্যাতে না ভেঙে যায়। সেই সঙ্গে দরকার প্রশাসন ও সাধারণ মানুষের সচেতনতা।
জলঙ্গি
(কৃষ্ণনগরের কাছে এই নদীর নাম খড়ে)
প্রবাহ পথ: মুর্শিদাবাদের জলঙ্গি থানার পদ্মা থেকে উৎপত্তি লাভ করে করিমপুর, তেহট্ট, নকাশিপাড়া, চাপড়া, ধুবুলিয়া, কৃষ্ণনগরের উপর দিয়ে আঁকাবাঁকা পথে প্রবাহিত হয়ে স্বরূপগঞ্জের কাছে ভাগীরথীতে মিলিত হয়েছে।
বর্তমান অবস্থা: সরকারি তথ্যের নিরিখে জলঙ্গী নদীর দৈর্ঘ্য ২২৩.৫ কিলোমিটার। বর্তমানে এই নদীর
মাত্র ১৭২.৫ কিলোমিটার তার অস্তিত্বকে বজায় রেখেছে। এই দৈর্ঘ্য আসলে মোক্তারপুর থেকে নদীর মোহনা পর্যন্ত। উৎস মুখের দিকে বাকি ৪৮ কিলোমিটার নদী দখল
হয়ে গিয়েছে। নদীর বুকে তৈরি হয়েছে বাড়ি-ঘর, চাষের জমি। তেহট্টের অনতিদূরেই নদীর বুকে প্রতি বছর মাটি ফেলে নদীর বুক প্রায় অর্ধেক বুজিয়ে ফেলা হয়েছে। কুমড়োধারী ঘাটের কাছে জলঙ্গি নদী একটা ড্রেনে পরিণত হয়েছে। কৃষ্ণনগরের কদমতলা ঘাটের উল্টো দিকে সাহেব নগর এলাকাতে
নদীর পাড় থেকে অবৈধ ভাবে মাটি কাটা হচ্ছে।
আশঙ্কা: নদীর উৎসমুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ার জন্য শুখা মরসুমে নদীতে জলের আকাল দেখা দেয়। যত্রতত্র নদীর ধার থেকে মাটি কাটার ফলে বন্যার সময় নদীর গতিশীল ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে। নদীর বুকে অবৈধ ভাবে ভেড়ি ও নদী অববাহিকা জুড়ে ভূমিক্ষয় বেড়ে যাওয়ার কারণে নদী অগভীর হয়ে পড়ছে। ফলে, নদীর মৃত্যু ত্বরান্বিত হচ্ছে।
প্রতিকার: নদীর পাড়ে অবৈজ্ঞানিক ভাবে মাটি কাটা বন্ধ করতে হবে। নদীতে ভেড়ি নির্মাণ করা যাবে না। ভূমিক্ষয় কমানোর জন্য নদীর অববাহিকা জুড়ে সবুজের ব্যাপ্তিকে বাড়াতে হবে।
অঞ্জনা
প্রবাহ পথ: কৃষ্ণনগরের কাছে জলঙ্গী নদী থেকে উৎপত্তি লাভ করে শক্তিনগর, দোগাছি, হাটবোয়ালিয়া, খামার শিমুলিয়া, ধর্মদহ, পাটুলি চন্দনদহ, বড় কুল্লা হয়ে এই নদীটি ব্যাসপুরের কাছে চূর্ণিতে মিশেছে। নদীর আরেকটি শাখা যাত্রাপুরের কাছ থেকে দ্বিধারায় বিভক্ত হয়ে তেঘরিয়া, বেড়াবেড়িয়া, জয়পুর, ইটাবেড়িয়া, হামাতপুর ইটাবেড়িয়া হয়ে হাঁসখালির কাছে চূর্ণী নদীতে মিশেছে। এই নদীটির দৈর্ঘ্য ৭০ কিমি।
বর্তমান অবস্থা: কৃষ্ণনগর পুরসভার নথি থেকে জানা যায় এই নদীর ৮৯ শতাংশ জবর দখল হয়ে গেছে। নদীর বুকে গজিয়ে উঠেছে বড় বড় অট্টালিকা। কৃষ্ণনগর শহরতলির সমস্ত বর্জ্য এই নদীর বুকে নিক্ষেপ করা হয়।
আশঙ্কা: কৃষ্ণনগর শহরতলির সম্পূর্ণ নিকাশিব্যবস্থা অঞ্জনার সঙ্গে যুক্ত। অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে কৃষ্ণনগরের বুকে জল জমে যায়। একমাত্র নিকাশি ব্যবস্থা অঞ্জনা নদী আজ ড্রেনে পরিণত হয়েছে। কাজেই জল নিকাশি সংস্যায় পড়তে হয় কৃষ্ণনগর পুরসভাকে।
প্রতিকার: এই নদীকে সংস্কার করলে কৃষ্ণনগর শহরতলি জল জমার হাত থেকে রোহই পাবে। এ ছাড়াও এই নদীতে ড্রেজিং করলে জলঙ্গীর অতিরিক্ত জল বয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা সে অর্জন করবে। স্বভাবতই এই নদী বন্যা নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করবে।
(ক্রমশ)
তথ্য: সুপ্রতিম কর্মকার।
ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য ও গৌতম প্রামাণিক।