রথ আছে। জগন্নাথ আছেন। আছে রথের রশি টানতে উপচে পড়া ভিড়। পুতুল থেকে পাঁপর ভাজা— সব আছে। নেই কেবল গুণ্ডিচা। হাজার বছরের প্রাচীন নবদ্বীপ কিংবা হালের মায়াপুর, কোথাও জগন্নাথ দেবের সেই অর্থে মাসির বাড়ি বলে কিছু নেই। অথচ, গঙ্গার দু’পাড়ে রথযাত্রা এবং উল্টোরথে সীমাহীন আড়ম্বর। দেশ-বিদেশের পর্যটকের ভিড়। কিন্তু সে সব রথের বেশির ভাগই রথযাত্রার দিন যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিল, সেখানেই ফিরে যায়।
রথযাত্রা শেষে প্রাচীন মায়াপুরের জগন্নাথ মন্দিরের বালক সাধুর রথ বা দেবানন্দ গৌড়ীয় মঠের রথ ছাড়া বেশির ভাগ রথই ফিরে যায় নিজ নিজ মন্দিরে। পুনর্যাত্রা বা উল্টো রথের দিন ফের নগর পরিক্রমা করে ওই মন্দির থেকেই। নবদ্বীপের অন্যতম প্রাচীন মণিপুর রাজবাড়ির রথের চাকা নবদ্বীপের পথে গড়াচ্ছে তিন শতক ধরে। মণিপুররাজ ভাগ্যচন্দ্র সিংহ নবদ্বীপে আসেন ১৭৯৭ সালে রাজকন্যা বিম্বাবতি মঞ্জরিকে নিয়ে। নবদ্বীপে স্থাপিত হয় রাজবাড়ি। মহারাজার মৃত্যুর পর রাজকুমার চৌরজিৎ সিংহ ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে মণিপুর রাজবাড়িতে রথের সূচনা করেন। গুণ্ডিচা প্রথা না থাকায় রাজবাড়ির অন্য চারটি মন্দির ঘুরে রথযাত্রার রাতে রথ ফিরে আসে রাজবাড়িতেই। উল্টোরথ পর্যন্ত এখানে প্রতি সন্ধ্যায় জয়দেবের পদ সহযোগে মণিপুরী নৃত্যের সঙ্গে জগন্নাথের সন্ধ্যারতি হয়।
নবদ্বীপের সারদেশ্বরী আশ্রমের সন্ন্যাসিনীদের রথ একই ভাবে মন্দির থেকে বেরিয়ে নগর পরিক্রমা করে ফিরে আসে মন্দিরে। উল্টোরথ পর্যন্ত বিশেষ সেবাপুজো হয় জগন্নাথের। তবে সারা বছর জগন্নাথ দেব যে ঘরে থাকে, এই আট দিনে তাঁর ঠাঁই বদল হয়। একতলা থেকে দোতলায় ওঠেন দেবতা। সেই তাঁর মাসির বাড়ি! পুনর্যাত্রার দিন আরও এক বার আশ্রম থেকেই পথে নামেন জগন্নাথ। ১৮৮৭ সালে সীতানাথ বৈষ্ণব থোরের রথযাত্রার সূচনা করেন পুরীর গোপীনাথ পান্ডা। তিনি পুরীধাম ছেড়ে নবদ্বীপধামে আসার সময় একটি জগন্নাথ মূর্তি সঙ্গে করে আনেন। সেটি প্রতিষ্ঠা করে পুরীর মন্দিরের অনুকরণে যাবতীয় সেবার ব্যবস্থা করেন। তাঁর আমলে রথযাত্রা চালু হয় গুণ্ডিচার ব্যতিরেকেই। নবদ্বীপের সুদর্শন মন্দিরের পতিতপাবন জগন্নাথ দেবও রথযাত্রা সেরে ফেরে প্রতাপনগরের নিজ মন্দিরেই। সেখান থেকেই পুনর্যাত্রায় বের হয়। মায়াপুর ইসকনের সাড়ম্বর রথে অবশ্য অস্থায়ী গুণ্ডিচা তৈরি করা হয়। আগে গঙ্গার ধারের খোলা মাঠে গুণ্ডিচা ঘিরে মেলা বসত। করোনা পরবর্তী সময়ে মন্দিরেই সাত দিন অবস্থান করে প্রভু জগন্নাথ।
কিন্তু কেন চৈতন্যভূমি নবদ্বীপের রথযাত্রা গুণ্ডিচা-হীন? শাস্ত্রজ্ঞেরা মনে করেন, উৎকলের রথযাত্রার সঙ্গে নবদ্বীপের রথযাত্রার ভাবগত অমিলই বেশি। ভাগবত পাঠক গোরাচাঁদ ভট্টাচার্যের মতে, নবদ্বীপের রথ আসলে চৈতন্য ভাবানুসরণ। মহাপ্রভু জগন্নাথের রথাগ্রে নৃত্য করতেন। নিজেকে জগন্নাথের একনিষ্ঠ সেবক বলতেন। তিনি অপ্রকট হওয়ার পর তাঁর ভক্তদের মধ্যে নেমে এসেছিল গভীর বিষাদ। অনেক পরে নবদ্বীপে যখন নতুন ভাবে বৈষ্ণবধর্মের পুনরুজ্জীবন ঘটছে, তখন তাঁর প্রিয় কাজগুলি অনুসরণের মাধ্যমে মহাপ্রভুকে ছুঁতে চেয়েছিলেন নবদ্বীপের ভক্তমণ্ডলী। নবদ্বীপের রথের যাত্রার সূচনা এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। তাই নবদ্বীপের রথযাত্রার চৈতন্য অনুষঙ্গই প্রাধান্য পেয়েছে। কীর্তন, নগর পরিক্রমা, বিশেষ সেবাপুজো, প্রসাদ বিতরণের আয়োজন হলেও উৎকল ভাবনার গুণ্ডিচা বা মাসির বাড়ির বিষয়টি গৌণ হয়ে পড়েছে। মনে করা হয়, পুরীর রথ বা উল্টোরথ আসলে সূর্যের উত্তরায়ণ এবং দক্ষিণায়ণ গতির প্রতীকী যাত্রা। জগন্নাথ দেবের রথ আসলে সূর্য দেবতার রথ। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের স্ত্রীর নাম ছিল গুণ্ডিচা। তিনিই প্রথম জগন্নাথ পুজো করেছিলেন।
নবদ্বীপের অন্যতম গুণ্ডিচা চৈতন্য জন্মস্থান আশ্রমের প্রধান অদ্বৈত দাস বলেন, “নবদ্বীপের সমস্ত রথই মহাপ্রভু পরবর্তী সময়ের। নীলাচলে মহাপ্রভু রথযাত্রায় যা করতেন, নবদ্বীপের রথযাত্রার ভক্তদের কাছে সেই আচরণ সমূহ পালন করাই মুখ্য। যার মধ্যে গুণ্ডিচা পড়ে না।” উৎকল সংস্কৃতির গুণ্ডিচা নিয়ে নবদ্বীপ প্রথম থেকেই অনাগ্রহী থেকেছে,
জানালেন তিনি।