মুখ্যমন্ত্রী চেয়েছিলেন, সোমবার সন্ধের পরে নবান্ন থেকে বেরিয়ে নীরবে পৌঁছে যাবেন কল্যাণীতে। জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের গেস্ট হাউসে রাত কাটিয়ে পরের দিন, অর্থাৎ মঙ্গলবার সকাল সকাল চলে যাবেন রানাঘাট মহকুমা হাসপাতালে। সেখানেই চিকিৎসাধীন রয়েছেন গণধর্ষণের শিকার গাংনাপুর কনভেন্ট স্কুলের বৃদ্ধা সন্ন্যাসিনী। মুখ্যমন্ত্রী যে হেতু পাইলট কার ব্যবহার করেন না এবং তাঁর নিরাপত্তারও আধিক্য নেই, তাই ওই পরিকল্পনা অনায়াসে বাস্তবায়িত করা যাবে ভেবেছিলেন নবান্নের শীর্ষ মহল। এমনকী, মুখ্যমন্ত্রীর সেই ইচ্ছে দুপুরের দিকেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁর ছায়াসঙ্গী এক পুলিশ কর্তাকে।
নবান্নের খবর, মুখ্যমন্ত্রীর ওই পরিকল্পনার কথা জানতেন প্রশাসনের সর্বোচ্চ মহলের দু-এক জন। তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীকে বলেছিলেন, ধর্ষণের ঘটনায় কেউ গ্রেফতার না-হওয়ায় রানাঘাট তেতে রয়েছে। যে হেতু মুখ্যমন্ত্রীর হাতেই রয়েছে পুলিশ দফতর এবং সেই পুলিশের বিরুদ্ধেই আমজনতার ক্ষোভ, তাই এখনই না গিয়ে দু-এক জন অভিযুক্ত গ্রেফতার হওয়ার পরে মুখ্যমন্ত্রী সেখানে গেলে ভাল করবেন। প্রশাসনের একটি সূত্র জানাচ্ছে, সেই পরামর্শ কানেই তোলেননি মুখ্যমন্ত্রী। তত ক্ষণে অবশ্য মুখ্যমন্ত্রীর ছায়াসঙ্গী পুলিশ কর্তা মারফত নদিয়া পুলিশ এবং সিআইডি-র জনা তিনেক অফিসার জেনে গিয়েছিল রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের পরিকল্পনাটি।
নদিয়ার এক পুলিশ কর্তা এ দিন বলেন, “সোমবার দুপুর ৪টে পর্যন্ত জানতাম মুখ্যমন্ত্রী বুধবার সকালে রানাঘাটে যাবেন। মঙ্গলবার রাতে থাকবেন কল্যাণীতে। সেই মতো সেখানকার গেস্ট হাউস সাফ সুতরোর কাজ চলছিল পুরোদমে। কিন্তু আচমকাই সংবাদমাধ্যমের কাছে শুনলাম এ দিনই মুখ্যমন্ত্রী রানাঘাট যাবেন। ফিরে যাবেন রাতেই।” সোমবার বিকেল সাড়ে ৩টে নাগাদ নবান্নে যখন সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী, তখনও তিনি বলেছিলেন, “আমি চেয়েছিলাম, আজ (সোমবার) না হয় কাল (মঙ্গলবার) যাব, কাল (মঙ্গলবার) না হয় পরশু (বুধবার) যাব। অভিযুক্তদের ধরা পড়ার সঙ্গে সকলের আবেগ জড়িয়ে আছে।” কিন্তু সোমবারই তাঁর যাওয়ার কথা সংবাদমাধ্যমে প্রচার হয়ে যাওয়ায় পুরো পরিকল্পনাটাই ‘আপসেট’ হয়ে গিয়েছে বলে তখনই জানিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী।
এর পরেই শুরু হয় পুলিশ মহলে হুলুস্থুল। মুখ্যমন্ত্রী নবান্ন থেকে রওনা দিয়েছেন এই খবর জেলায় পৌঁছনো মাত্র সব থানার ওসিকে বেতার বার্তা মারফত রানাঘাটে চলে আসতে বলেন পুলিশ কর্তারা। সদর দফতর কৃষ্ণনগর থেকেও দলে দলে সশস্ত্র বাহিনী রওনা দেয় গাংনাপুরের উদ্দেশে। কিন্তু ওই জোগাড় যন্তরের ফাঁকে যে তলায় তলায় বিক্ষোভের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে, তা টের পায়নি নদিয়া পুলিশ। আর এখানেই গোয়েন্দা বিভাগের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন প্রশাসনের একাংশ।
নদিয়ার এসপি অর্ণব ঘোষও পুলিশি গাফিলতি মেনে নিয়েছেন। মঙ্গলবার তিনি বলেন, “পড়ুয়ারা মিছিল করছিল। তাদের সামনে রেখে এ ধরনের বিক্ষোভ যে হতে পারে তা কেউ আঁচ করতে পারেনি।” কিন্তু দুপুর থেকেই তো ‘অকর্মা পুলিশ’, ‘রাজ্যে নারী নিরাপত্তার বেহাল অবস্থা’ লেখা প্ল্যাকার্ড ও ফেস্টুন নিয়ে সাধারণ মানুষ এলাকায় একাধিক মিছিল বের করেছিলেন, তাতেও কি কিছুই আঁচ মেলেনি? এ বার এসপি-র যুক্তি, “এ তো ঘটনার শুরুর দিন থেকেই চলছে। তাই বিষয়টির গুরুত্ব আমরা ধরতে পারিনি।” নবান্ন সূত্র জানাচ্ছে, নদিয়ার জেলাশাসক পরভেজ বি সেলিম ও রাজ্য পুলিশের ডিজি জিএমপি রেড্ডি মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্র দফতরে যে পৃথক রিপোর্ট জমা দিয়েছেন, সেখানেও জেলা পুলিশের গাফিলতির উল্লেখ রয়েছে।
স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তা জানাচ্ছেন, রানাঘাট হাসপাতালের প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বেশ খুশিই ছিলেন। কিন্তু হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে দেড় কিলোমিটার দূরে জাতীয় সড়কে তাঁর কনভয় পড়তেই তা আটকে দেন স্থানীয় স্কুলের পড়ুয়া ও অভিভাবকেরা। বিক্ষোভে সামিল হন এলাকার বাসিন্দারাও। দু’টো রিপোর্ট দেখে নবান্নের কর্তাদের মনে হয়েছে প্রতিবাদী মিছিলটি মুখ্যমন্ত্রীর কনভয়ের কাছাকাছি আসতে দেওয়াটাই ঠিক হয়নি। যে ভাবে জনতা মুখ্যমন্ত্রীর গাড়ি দীর্ঘ ক্ষণ আটকে রাখল, তা জেলা পুলিশের অদক্ষতারই নজির। তবে জনতার অবরোধে সিপিএম এবং বিজেপির হাত রয়েছে বলে রানাঘাটে দাঁড়িয়ে সোমবার যে ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী, নবান্নে পৌঁছনো প্রশাসনিক রিপোর্টে তার কোনও উল্লেখ নেই। বরং, স্কুলের পড়ুয়ারা বিক্ষোভে সামিল হওয়ায় পুলিশকে ধৈর্য ধরে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়েছিল বলে জানানো হয়েছে রিপোর্টে।