জয়ন্ত পাল (১৯৬৬ সালের ৪ মার্চ পুলিশের গুলিতে আহত)
চারদিকে তখন প্রচণ্ড খাবারের আকাল। কোথাও চাল মিলছে না। ভুট্টা আর মাইলো খেয়ে থাকতে হচ্ছে। সেটাও জুটছে না সকলের।
আমার বাবা ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী অশ্বিনী পাল। কৃষ্ণনগর আদালতের বিশিষ্ট আইনজীবীও। তবু আমাদেরও মাইলো খেতে হচ্ছে। বিচলিত হয়ে পড়েছেন বাবাও। শহরে একটা অগ্নিগর্ভ অবস্থা।
আমি তখন কৃষ্ণনগর এ ভি স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ি। সহপাঠীরাও আলোচনা করছি, কিছু একটা করা জরুরি। এরই মধ্যে কেরোসিন ও খাদ্যের দাবিতে ৪ মার্চ ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হল। ধর্মঘট সফল করতেই হবে। স্কুলে গেলাম। অনেক বন্ধুই এসেছে। সকলে গিয়ে দাঁড়ালাম স্কুলগেটের সামনে।
বেলা তখন ১১টা হবে। বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রদের একটা বিশাল মিছিল এগিয়ে এল আমাদের স্কুলের দিকে। আমরাও মিছিলে মিশে গিয়ে এগিয়ে চললাম পোস্ট অফিস মোড়, সদর মোড় হয়ে জেলা প্রশাসনিক ভবনের দিকে। সেখান থেকে ঘুরে ফিরছি পোস্ট অফিস মোড়ের দিকে। সরকার বিরোধী স্লোগান চলছে নাগাড়ে।
হঠাৎ দেখি, উল্টো দিক থেকে পুলিশের একটা বড় গাড়ি এগিয়ে আসছে। গাড়িটা কাছাকাছি আসতেই মিছিল থেকে ইট ছোড়া শুরু হল। সে এক ভয়ঙ্কর উত্তেজনা। বেগতিক বুঝে পুলিশের গাড়ি পিছু হটতে লাগল। আমরা পোস্ট অফিস মোড়ের কাছে, পুলিশের গাড়ি পুরসভা মোড়ে। গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে আসতে লাগল পুলিশ। আমাদের দিক থেকে ইট উড়ে যাচ্ছে। পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে শুরু করল। ধোঁয়ায় চোখ জ্বলে যাচ্ছে। কিন্তু কেউই পিছু হটতে রাজি নয়।
এরই মধ্যে হঠাৎ গুলির শব্দ!
পোস্ট অফিস মোড় তার মধ্যে অনেকটাই ফাঁকা। আমি জজ কোর্টের কাছে। গুলির শব্দ শুনে পাঁচিল টপকে পালাতে যাব, হঠাৎ পায়ে অসহ্য যন্ত্রণা। মনে হল, ডান পা-টাই বুঝি আর নেই। রক্তে ভেসে যাচ্ছে মাটি। পাঁচিল ধরেও দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। পড়ে গেলাম মাটিতে। চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে। গোটা এলাকা মুহূর্তের মধ্যে ফাঁকা।
এত যন্ত্রণা হচ্ছিল যে মনে হচ্ছিল, এখনই মরে যাব। খানিক পরে দেখি, কয়েক জন পুলিশ এগিয়ে আসছে। তারাই ধরাধরি করে একটা রিকশায় তুলে দিল। কিন্তু রিকশাচালক ভয়ে আমায় ফেলে পালালেন। এ বার পুলিশ এসে তাদের সেই বড় গাড়িটায় তুলল। কিন্তু এরই মধ্যে চলে এসেছে অ্যাম্বুল্যান্স। আমায় নিয়ে যাওয়া হল সদর হাসপাতালে। জানা গেল, গুলি লেগে ডান পায়ের হাঁটুর নীচের হাড় ভেঙে চার টুকরো হয়ে গিয়েছে। তখনও আমি জানি না, কৃষ্ণনগরে কী ভয়ঙ্কর সব ঘটনা ঘটে গিয়েছে। পরে আস্তে আস্তে জানতে পারছি। আমাদেরই মিছিলে পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছে দেবনাথ স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র আনন্দ হাইত। পরের দিন আবারও পুলিশের গুলিতে মারা গেলেন হরি বিশ্বাস, শক্তিনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র অর্জুন ঘোষ। এরই মধ্যে নেদেরপাড়ার গলিতে দুই পুলিশকর্মী নরেন দাস ও সুদর্শন ঘোষকে পিটিয়ে মারলেন আন্দোলনকারীরা। সরকারি অফিসে আগুন। কার্ফু জারি হল। শহর জুড়ে চরম অত্যচার নামিয়ে আনল পুলিশ।
শুনছি, আর শিউরে উঠছি। একে একে হাসপাতালে এসে দেখা করে যাচ্ছেন কাশীকান্ত মৈত্র, রাম মনোহর লোহিয়া, হেমন্ত বসুর মতো বড় নেতারা। ৩১ মার্চ বিধায়ক কাশীকান্ত মৈত্রের উদ্যোগে এবং তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী পুরবী মুখোপাধ্যায়ের হস্তক্ষেপে আমায় নিয়ে গিয়ে ভর্তি করানো হল কলকাতার নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে। সেখানে থাকতে হল প্রায় সাত মাস।
যখন বাড়ি ফিরলাম, ডান পা ইঞ্চি দেড়েক ছোট হয়ে গিয়েছে। খুঁড়িয়ে হাটি। অনেকেই বিদ্রুপ করে, ‘হাফ শহিদ’ বলে ডাকে। কষ্ট হয়। তা-ও এক দিন সয়ে গেল বোধ হয়। বছর দুয়েক আগে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি। কিন্তু গুলিটা যেন একেবারে বুকের মধ্যে বিঁধে আছে।
কেবলই মনে হয়, সে দিন আনন্দ হাইতের মতো আমিও তো শেষ হয়ে যেতে পারতাম।