সুনসান রানাঘাট। বৃহস্পতিবার সুদীপ ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।
ধর্ষণের ঘটনায় কাউকে এখনও পাকড়াও করা যায়নি। কিন্তু সোমবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথ আটকেছিলেন যাঁরা, সেই বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করতে তৎপর হয়ে উঠল পুলিশ।
এমন কোনও পদক্ষেপ যে প্রশাসন করতে চলেছে, তার আঁচ মিলেছিল সোমবারই। রানাঘাটে কনভেন্ট স্কুলে লুঠপাট এবং সত্তরোর্ধ্ব সন্ন্যাসিনীকে ধর্ষণের জেরে ঘটনাস্থলে গিয়ে বিক্ষোভে অবরুদ্ধ হয়ে মুখ্যমন্ত্রী হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন যাঁরা এমন কাজ করলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিক্ষোভের পিছনে সিপিএম এবং বিজেপি, দুই বিরোধী দলের হাতও দেখেছিলেন তিনি। এর পরে বিক্ষোভকারীদের ‘চিহ্নিত’ করার কাজও শুরু করে দেয় জেলা তৃণমূল। বৃহস্পতিবার পুলিশ জানিয়ে দিল, বিক্ষোভকারীদের চিহ্নিত করে মামলা হয়েছে। আইনানুগ ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।
মুখ্যমন্ত্রী জেড প্লাস ক্যাটিগরির নিরাপত্তা পান। রাস্তায় তাঁর গাড়ি আটকে বিক্ষোভ মানে সেখানে তাঁর নিরাপত্তার প্রশ্নও জড়িয়ে যায়। এমন কোনও ঘটনা ঘটলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা করতে আইনত কোনও বাধা নেই। কিন্তু এ সব ক্ষেত্রে স্থানীয় মানুষের ‘স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভ’ বা ভাবাবেগ জড়িয়ে থাকে বলে সাধারণত কোনও দলই মামলার পথে হাঁটে না। কামদুনিতে নিহত মেয়েটির বাড়ি থেকে বেরিয়েই স্থানীয়দের এমন ক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন মমতা। সেখানে মেজাজ হারিয়ে ধমকে টুম্পা-মৌসুমীদের থামিয়ে দিলেও পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ঘেরাও নিয়ে কোনও মামলা করেনি। একই ভাবে বাম জমানার শেষ দিকে একাধিক বিক্ষোভের মুখে পড়লেও মমতার পূর্বসূরি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকারও স্থানীয় মানুষের মনোভাব আঁচ করেই পুলিশি ব্যবস্থা নেয়নি। সেই অর্থে রানাঘাটে ব্যতিক্রমী পদক্ষেপই করল মমতার সরকার। কিন্তু কেন?
শাসক দল তৃণমূলের তরফে বলা হয়েছে, ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে মুখ্যমন্ত্রী যখন এলাকায় ছুটে গিয়েছেন, তখন তাঁকে ঘিরে যে বিক্ষোভ দেখানো হয়েছে, তা চরম অসৌজন্য। এমন ঘটনায় প্রশাসনিক পদক্ষেপ করা না হলে ভবিষ্যতে আরও বিশৃঙ্খলাকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে। তৃণমূলের অন্দরমহলের একটি অংশের বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রীর পথ আটকে বিক্ষোভ দেখানোর পরিকল্পনা আগেভাগেই তৈরি করা হয়েছিল। এবং সেই ‘ষড়যন্ত্রের’ পিছনে সিপিএম ও বিজেপি তো বটেই, মাওবাদীদের কেউ কেউও থাকতে পারে। এই ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার প্রবল আশঙ্কা ছিল। তাই মামলা করে ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে প্রশাসন।
জেলা পুলিশ সূত্র জানাচ্ছে, মামলা রুজু হয় ঘটনার দিন, সোমবারই। জেলা পুলিশের এক কর্তা সেই দিনই জানিয়েছিলেন, তাঁরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা করেছেন। কয়েক জনকে চিহ্নিতও করা হয়েছে। তা হলে কেন এখনই তাঁরা ব্যবস্থা নিচ্ছেন না এর জবাবে ওই কর্তা জানান, ধর্ষণের ঘটনায় যেখানে অপরাধী অধরা, সেখানে বিক্ষোভের জেরে কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে মানুষের ক্ষোভ আরও বেড়ে যাবে।
ক্ষোভ যে এখনও বাড়তে পারে, তার ইঙ্গিত দিয়েছে বিরোধী দলগুলি। সিপিএম নেতৃত্ব বলছেন, কোনও না কোনও প্রশ্নে স্থানীয় মানুষের ক্ষোভ থাকলে এমন বিক্ষোভ হয়ে থাকে। চিরকালই তেমন ঘটনায় সুযোগ পেয়ে স্থানীয় রাজনীতির মানুষজনও ঢুকে পড়েন। কিন্তু মানুষের ভাবাবেগ মাথায় রেখেই প্রশাসন সচরাচর এর জন্য ব্যবস্থা নিতে এগোয় না। বাম জমানার শেষ দিকে উল্টোডাঙার বাসন্তী কলোনিতে আগুন লাগার পরে ঘটনাস্থলে গিয়ে বিক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। রিজওয়ানুর রহমানের বাড়ি যাওয়ার পথে বিক্ষোভের মুখে গাড়ি রেখে পায়ে হেঁটে গিয়ে রিজের মায়ের সঙ্গে দেখা করেছিলেন তিনি। আবার আয়লার পরে ত্রাণ কেন মিলছে না, এই অভিযোগে সন্দেশখালি এবং সুন্দরবনে বিডিও অফিসে তাঁকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখিয়েছিল ক্রুদ্ধ জনতা। এর মধ্যে একটি ঘটনায় সিপিএম বিধায়ক, অধুনা-প্রয়াত গোপাল গায়েনের গায়ে-মাথায় কাদা লেপে দেওয়ার নজিরও আছে। এই সব উদাহরণ দিয়ে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলছেন, “প্রতিহিংসা এই সরকারের ডিএনএ-তে! তারা তো এ কাজ করবেই!”
বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের মন্তব্য, “এই সিদ্ধান্তে স্পষ্ট, রানাঘাটের মূল ঘটনায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ ছিল স্রেফ বাধ্যবাধকতা। আর বিক্ষোভকারীদের শাস্তি দেওয়াটা হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে উৎসারিত মনোবাসনা!”
তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের পাল্টা যুক্তি, “ব্যবস্থা না নেওয়ার কী আছে? বেআইনি কোনও কাজ করা হয়েছে? ঘটনার দ্রুত কিনারার আশ্বাস দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ঘটনাস্থলে গিয়েছেন আর তাঁকে রাস্তায় আটকে বিক্ষোভ হচ্ছে! ব্যবস্থা না নেওয়া হলে এই রকম বিশৃঙ্খলা তো প্রশ্রয় পাবে!”
পার্থবাবুর আরও দাবি, “সে দিন মুখ্যমন্ত্রী অসীম ধৈর্য এবং সহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়েছেন। পুলিশকে ডেকে ওখানে ব্যবস্থা নিতে বলেননি। কিন্তু সহিষ্ণুতাকে দুর্বলতা ভাবলে ভুল হবে!” অতীতে মুখ্যমন্ত্রীকে ঘিরে বিক্ষোভের পরেও তো প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি? তাঁর ব্যাখ্যা, “ওই সব ঘটনার সঙ্গে এর তুলনা করা যায় না। এটা অনেক গুরুতর। ওই ঘটনাগুলিতে মুখ্যমন্ত্রী (বাম জমানার) কোনও ব্যবস্থা না নিয়ে এলাকায় গিয়ে ক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন। পুলিশও সক্রিয় হয়ে তাঁকে বার করে এনেছিল। কিন্তু এখানে মুখ্যমন্ত্রী ব্যবস্থা নিয়ে যাওয়ার পরেও শুধু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তাঁর প্রতি অসৌজন্য দেখানো হয়েছে!”