নোটের নাচন

গালে গজাচ্ছে দাড়ি, চিকেন লন্ড্রি ভুলে এই তো বেশ আছি

বিপাকে পড়লে বাঘের মুখেও ধান রোচে! বাঘ না হয় জাতীয় পশু। কিন্তু সাধারন মানুষ? নোটের আকালে তাঁরাও ভিজে বেড়াল হয়ে বদলে ফেলেছেন নিত্যকার অভ্যাস!

Advertisement

অনল আবেদিন

বহরমপুর শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০১৬ ০০:১৫
Share:

রমাপ্রিয় ভট্টাচার্য ও গীতা কর্মকার ।—নিজস্ব চিত্র

বিপাকে পড়লে বাঘের মুখেও ধান রোচে!

Advertisement

বাঘ না হয় জাতীয় পশু। কিন্তু সাধারন মানুষ? নোটের আকালে তাঁরাও ভিজে বেড়াল হয়ে বদলে ফেলেছেন নিত্যকার অভ্যাস!

বছর সাতেকের সুতনু মণ্ডল যেমন, রেডি ফুডের সালতামামিতে বাড়ির চিলি চিকেন ছাড়া ভাত মুখে উঠত না তার। নোটের গেরোয়, বাপ-মা’র ধমকে এখন শীতের সস্তাতম ফুলকপির ডালনাতেই দিব্যি সড়গড় হয়ে উঠেছে সে। ষাটোর্ধ্ব গীতা কর্মকারও বাধ্য হয়ে ছেড়ে দিয়েছেন লন্ড্রির অভ্যাস। এখন ধোপদুরস্ত থাকতে নিজের কাপড় নিজেই কেচে হাঁফিয়ে উঠে বলছেন, ‘‘এই বেশ বাবা, লন্ড্রি একটা নিতান্তই বদভ্যাস!’’

Advertisement

নবদ্বীপের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মাখনলাল দেবনাথও যেমন ধরা গলায় কবুল করছেন, ‘‘সাত জনের সংসারে নিত্যকার শ’খানেক টাকার মাছ না হলে ভাত উঠত না। এখন আমরা ডিমে ফিরে গিয়েছি বাবা!’’

তা হলে কি ধরে নেব নোটের নাচনে সাশ্রয়ের বহর বেড়েছে ওঁদের?

টাকার খামতি নেই। কিন্তু তা নিতান্তই ভার্চুয়াল! খাতায় কলমে আছে, ব্যাঙ্কের পাস বইয়ে। তার পরে? নাঃ, আর দেখা নেই তার। মুর্শিদাবাদ জেলার লিড ব্যাঙ্কের ম্যানেজার অমিত সিংহের পরিসংখ্যান বলছে— শহর-গ্রাম মিলিয়ে মুর্শিদাবাদে প্রায় হাজার দুয়েক ব্যাঙ্ক রয়েছে। প্রায় ৭৩ লক্ষ মানুষের জন্য যথেষ্ট। রয়েছে প্রায় শ’পাঁচেক এটিএম কাউন্টার। অমিত বলছেন, ‘‘কিন্তু থেকে কী হবে, সচল তো সাকুল্যে পনেরো শতাংশ!’’

আর তাই, থেকেও না থাকা সেই টাকা হাতে না পাওয়ায় হপ্তায় দু’বার সেলুনে গিয়ে দাড়ি কামানোর অভ্যাস তুলে রেখে হালে দাড়ি রাখতে শুরু করেছেন এক কলেজ শিক্ষক। বলছেন, ‘‘অন্তত ত্রিশ টাকার ধাক্কা, সামাল দেব কী করে!’’ লালগোলার শামিমা খাতুনও বাইরে পা রাখলেই ‘এই টুকটুক’ হাঁকটাই ভুলে গেছেন। দিব্যি হেঁটেই সেরে নিচ্ছেন, বাজার থেকে বন্ধুর বাড়ি যাতায়াত। ব্যাঙ্ক কর্তারা জানাচ্ছেন, হাতে টাকা না থাকার ফলে অভ্যাস বদলটাই এখন দস্তুর হয়ে গিয়েছে অনেকের কাছে।

যার ফলে মার খাচ্ছেন, নবদ্বীপ বাজারের মাছওয়ালা কিংবা বহরমপুরের মোহন মোড়ের সেলুন মালিক গৌরচন্দ্র বিশ্বাস। বলছেন, ‘‘চুল তো দূরের কথা, দাড়ি
কামানোই ভুলে গিয়েছেন
অনেকে।’’ পাশেই লণ্ড্রি মালিক বিমলকুমার রজকের দোকান। তিনিও মানছেন, নোটকাণ্ডে খদ্দের প্রায় অর্ধেক। লালগোলার টুকটুক চালক শ্রবন সিংহও আক্ষেপ লুকোতে পারছেন না, ‘‘মাস খানেক আগেও দিনে ছ’শো টাকা আয় হত, এখন মেরেকেটে দু’শো। পাঁচ জনের
সংসার চলে!’’

কৃষ্ণনগরের পোস্ট অফিস মোড়ের বাসিন্দা দয়ারাম সামন্তের ফর্দ থেকেও নিশ্চুপে গত দু’মাস ধরে বাদ পড়ে চলেছে, শ্যাম্পু, সাবান।

মাস খানেক আগেও পুরনো নোটে কষ্টেসৃষ্টে যাচ্ছিল। এখন তাও দেহ রেখেছে। আর তাই আমুল বদলে গিয়েছেন রমাপ্রিয়বাবু।

অভ্যাস বদলের শেষ গল্পটা তাঁকে নিয়েই। নবদ্বীপের বাসিন্দা প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষক রমাপ্রিয় ভট্টাচার্য, সাত সকালে মোটরবাইক ছুটিয়ে যেতেন সমুদ্রগড়ের স্কুলে। পুরনো নোট ফুরোতেই, নটে গাছ মুড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। বলছেন, ‘‘ট্রেনই ভাল ভাই, বাইক মানেই তেলের খরচ, না হয় একটু ভিড় হয়, তাতে আর কী!’’

(তথ্য সহায়তা: দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement