বহরমপুরে ইন্দ্রাশিস বাগচীর তোলা ছবি।
হাতে একমুঠো কয়েন। চোখ দুটো ঘোলাটে। বাস, ট্রাকের কোরাসে হারিয়ে যায় হাসান সরকারের গলা। আওয়াজ একটু কমলে ফের তিনি খেই ধরেন, ‘‘চোখে দেখতে পাই না। আর তার সুযোগ নিয়ে অনেকেই ভিক্ষা হিসেবে এক টাকার কয়েন গুঁজে দেন। ঘরে ফিরে মুদির দোকানে গিয়ে সেই কয়েন নিয়ে মুখ ঝামটা খেতে হয়।’’
ইসলামপুরের হাসান সরকার একা নন, তাঁর মতো বহু ভিখিরিই খুচরো নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। কারও কাছে জমে গিয়েছে পাঁচ হাজার টাকার কয়েন, কারও কাছে দশ হাজার। তাঁদের কথায়, ‘‘বাড়িতে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। অথচ এই টাকা বাড়িতে জমে আছে। খরচ করতে পারছি না।’’
মুর্শিদাবাদের ইসলামপুর এলাকার একটি প্রতিবন্ধী সংগঠনের সম্পাদক গোলাম মোর্তাজা বলছেন, ‘‘বছর কয়েক থেকেই এই কয়েন নিয়ে সমস্যায় পড়েছি আমরা। মানুষ আমাদের হাতে এক টাকার কয়েন ধরিয়ে দিচ্ছেন। অথচ বাসে উঠে, হোটেলে খেতে গিয়ে কিংবা মুদির দোকানে চাল-ডাল কিনতে গেলে আমাদের কাছ থেকে সেই কয়েন আর কেউ নিচ্ছেন না।’’
সেকাল: হরিহরপাড়ায় মফিদুল ইসলামের তোলা ছবি।
প্রশাসন ও ব্যাঙ্কের কাছে দরবার করেছে মুর্শিদাবাদের ইসলামপুরের ওই সংগঠনের সদস্যেরা। এমনকি খুচরো না নেওয়ার প্রতিবাদে ব্যাঙ্কের দুয়ারে ধর্না ও করিমপুর বহরমপুর রাজ্য সড়কে খুচরো ছড়িয়ে রাস্তা অবরোধও করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু তার পরেও ছবিটা বদলায়নি।
ডোমকলের কাটাকোপরা এলাকার হাফিজুল শাহ ভিক্ষা করে সংসার চালান। তাঁর দাবি, ‘‘কয়েন বিভ্রাটের ফলে অনেক দিন বাজার পর্যন্ত করতে পারি না। মুদির দোকানে নিতে চায় না। বাসে উঠলেও কন্ডাক্টর মুখ করে। আমাদের কথা শোনার কেউ নেই।’’
জলঙ্গির তহুরা বিবির স্বামী আর চলাফেরা করতে পারেন না। তহুরা হেঁটে ভিক্ষা করেন ডোমকল, জলঙ্গি, রানিনগর এলাকার বিভিন্ন বাজারে। তাঁর কথায়, ‘‘একটা সময় একা একা ভিক্ষা করতাম। কিন্তু এই এক টাকার কয়েন কেউ নিচ্ছে না বলে সমস্যায় পড়েছি। এখন তাই দলবেঁধে ঘুরি। পাঁচ জন মিলে একটা দল করেছি। কোনও দোকান বা বাড়িতে গিয়ে আমরা পাঁচ টাকার কয়েন দিতে বলি। দিনের শেষে সবাই মিলে টাকাটা ভাগ করে নিই।’’
কিন্তু এর অন্য অসুবিধাও রয়েছে। ভিখিরিরা জানাচ্ছেন, এর ফলে ভিক্ষা দেওয়ার প্রবণতা আগের থেকে কমেছে মানুষের মধ্যে। অনেকেই পাঁচ টাকা, দশ টাকা একসঙ্গে দিতে চান না। ইসলামপুরের বাসিন্দা তথা স্থানীয় তৃণমূল নেতা নারায়ণ দাস বলছেন, ‘‘ওঁদের জন্য আমরা অনেক বার পথে নেমেছি, থানা ও ব্যাঙ্কে গিয়েছি। প্রশাসনের কর্তাদের জানিয়েছি। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কোনও সুরাহা মেলেনি।’’
রানিনগরের সুরমা বিবি প্রতিদিন তাঁর ব্যাগ থেকে একমুঠো এক টাকার কয়েন নিয়ে বের হন রাস্তায়। আপ্রাণ চেষ্টা চালান অল্প অল্প করে চালিয়ে দেওয়ার। কিন্তু বেশিরভাগ সময় তাঁকে হতাশ হতে হয়। সুরমা বলছেন, ‘‘আমরাই তো অচল হয়ে গেলাম গো। পয়সার আর কী দোষ দেব!’’