সাগরদিঘিতে পুলিশের গাড়ি আটকে বিক্ষোভ। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়
অকারণ এই ভয়ের মাসুল গুনতে হবে আর কত দিন? প্রশ্নটা উঠছে প্রশাসনের অন্দরমহল থেকে প্রত্যন্ত গাঁ-গঞ্জেও।
এনআরসি-র আতঙ্কে স্বাস্থ্যকর্মী, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মী ও রেশন ডিলারদের বাড়ি ঘেরাও করে বিক্ষোভ, হেনস্থার মতো ঘটনার সাক্ষী থেকেছে মুর্শিদাবাদের হরিহরপাড়া, ডোমকল ও লালবাগ-সহ বেশ কিছু এলাকা। এ দিকে, সাগরদিঘিতেও এনআরসি আতঙ্কে ইন্টারনেট সাথী’র মহিলা কর্মীদের উপর হামলা যেন থামতেই চাইছে না। শনিবারও চলে হামলা, রাস্তা অবরোধ। ইন্টারনেট সাথী প্রকল্পে কর্মরত মহিলাদের উপর গ্রামবাসীদের হামলা ভয়াবহ আকার নিয়েছে সাগরদিঘির বিস্তীর্ণ এলাকায়।
এ দিন সাগরদিঘির জোতকমল গ্রামে সকাল থেকেই গ্রামবাসীদের একাংশ চড়াও হন ওই প্রকল্পের কর্মী রাকিবা খাতুনের বাড়িতে। শুক্রবারও তাঁর বাড়িতে চড়াও হয়েছিলেন বেশ কিছু গ্রামবাসী। পুলিশ উদ্ধার করে নিয়ে গিয়ে দিনভর থানায় রেখে দেওয়ার পরে সন্ধ্যায় বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। বাড়িতে ফিরতেই রাত থেকেই শুরু হয়ে যায় ফের হামলা। পুলিশ, পঞ্চায়েত প্রধান, স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্যরা গ্রামবাসীদের বোঝানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। বাধ্য হয়ে পুলিশ রকিবাকে উদ্ধার করে ফের সাগরদিঘি থানায় নিয়ে যায়। গ্রামবাসীদের হামলায় বিধ্বস্ত রাকিবা খাতুন থানায় বসে কান্নায় ভেঙে পড়েন। দুই নাবালক ছেলের কথা ভেবেই চিন্তিত তিনি।
রাকিবাকে পুলিশ থানায় উদ্ধার করে নিয়ে যেতেই ক্ষুব্ধ গ্রামবাসীরা রতনপুরে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ করেন। খবর পেয়ে জঙ্গিপুরের এসডিপিও ঘটনাস্থলে পৌঁছে অবরোধকারীদের বোঝানোর চেষ্টা করেও অবরোধ তুলতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত গোটা বিষয়টি দেখভালের জন্য ১০ জন গ্রামবাসীকে নিয়ে একটি কমিটি তৈরি করার কথা বললে অবরোধ উঠে যায়। তত ক্ষণে তিন ঘন্টা পেরিয়ে গিয়েছে।
পুলিশ জানাচ্ছে, গত চার দিনে ১৮ জন কর্মীর উপরে হামলা হয়েছে। সেই হামলা থেকে রেহাই মেলেনি গর্ভবতী মহিলারাও। হামলায় আক্রান্ত হওয়ায় অনেকেই বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন, কেউ থানায় আশ্রয় নিয়েছেন। সাগরদিঘি ব্লকের কো-অর্ডিনেটর মতিউর রহমান বুধবার থেকে বাড়ি ছেড়ে সাগরদিঘি থানার আশ্রয়ে। বৃহস্পতিবার দিনভর বিভিন্ন গ্রামের পঞ্চায়েত সদস্য, প্রধান, পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি ও আক্রান্ত স্বেচ্ছাসেবী কর্মীদের নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করেন জঙ্গিপুরের এসডিপিও, সাগরদিঘির বিডিও। সিদ্ধান্ত হয়, পঞ্চায়েত সদস্য ও প্রধানেরা এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবেন, প্রচার করা হবে ওই তথ্য সংগ্রহের সঙ্গে এনআরসি’র কোনও সম্পর্ক নেই। কিন্তু তার পরেও শুক্রবার সকাল থেকেই রতনপুর, জোতকমল, চালতাবাড়ি, বেলাইপাড়া গ্রামগুলিতে ওই মহিলা কর্মীদের উপর একের পর এক হামলা শুরু হয়।
৪টি গ্রামের ৭০০ মহিলাকে মোবাইল ও ইন্টারনেটের ব্যবহার শেখানো লক্ষ্যমাত্রা ছিল। ৬৫৫ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর এনআরসি নিয়ে ক্ষোভ শুরু হতেই ১৫ দিন আগে কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। মতিউর রহমান বলেন, “গ্রামের কোনও মহিলার কাছে কোনও নথি পত্র নেওয়া হয়নি। শুধু একটি করে ছবি তোলা হয়েছে মহিলাদের যাতে কতজন মহিলাকে মোবাইলের ব্যবহার শেখানো গিয়েছে তার রিপোর্ট দিতে।” এখন এনআরসি আতঙ্কে গ্রামবাসীরা মোবাইলে তোলা ছবি ফেরতের দাবি তুলেছেন।
সাগরদিঘির ফুলশহরি গ্রামেই এনআরসি আতঙ্কে মৃত্যু হয় কুদরত শেখের। স্বভাবতই গ্রামজুড়ে আতঙ্ক এন আর সি নিয়ে। ওই গ্রামের বাসিন্দা জঙ্গিপুর কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী নুরতাজ খাতুন বলছেন, “ এতদিন কাজ করেছি কোনও সমস্যা হয় নি। হঠাৎ বুধবার রাতে বাড়িতে চড়াও হয় কিছু মহিলা। আমাকে মারধর করে। মাকে নিগ্রহ করা হয়। বাড়ি থেকে পালিয়ে রয়েছি আমি। গ্রামবীসাদের গোটা বিষয়টি খোলসা করে জানানোর জন্য মাইকে প্রচার করার কথা ছিল। শনিবার রাত পর্যন্ত তাও হয়নি।
জঙ্গিপুরের এসডিপিও প্রসেনজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “ওই প্রকল্পে কর্মরত ৩৫ জন মহিলাকে বাড়ি থেকে সরিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা সাগরদিঘির ওসিকে বলা হয়েছে। তত দিন মাইকে প্রচার চলবে। পঞ্চায়েত সদস্য ও প্রধানেরাও গ্রামে গ্রামে ঘুরে বোঝাবেন। মসজিদগুলি থেকেও প্রচার করা হবে।”