ডাক্তারবাবু রাসায়নিক নামে (ডাক্তারি পরিভাষায় যাকে বলে ‘জেনেরিক’ নাম) ওষুধ লিখছিলেন। সেটাই নিয়ম। ন্যায্য মূল্যের দোকান থেকে ওষুধ কিনে এনে দিচ্ছিলেন বাচ্চাটির বাড়ির লোক।
টানা তিন দিন হাসপাতলে ভর্তি থাকার পরেও জ্বর না কমায় চাপে পড়ে যান সংশ্লিষ্ট শিশু বিশেষজ্ঞ। বাইরের দোকান থেকে অন্য ওষুধ কিনে আনতে বলেন তিনি। সরকারি প্রেসক্রিপশনে নয়, সাদা কাগজে নাম লিখে। সেই ওষুধ চালু হওয়ার পরে বাচ্চাটির জ্বর কমে।
ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান চালু হয়ে গরিব রোগীদের যে অনেকখানি উপকার হয়েছে, তা অস্বীকার করছেন না কেউই। সরকারের বেঁধে দেওয়া ১৪২টি ওষুধ অনেক কম দামে পেয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে জনপ্রিয় ওষুধের তুলনায় ন্যায্য মূল্যে বিক্রি হওয়া অনেক ওষুধেরই ক্ষমতা কম, বলছেন চিকিৎসকেরাই। ফলে কাজ হতে দেরি হচ্ছে। রোগী ও তাঁর বাড়ির লোকেরা অস্থির হয়ে পড়ছেন। ডাক্তারও চাপে পড়ে যাচ্ছেন।
মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক সুপ্রতীক চক্রবর্তী বলেন, ‘‘হাসপাতালের রোগীদের প্রেসক্রিপশন লেখার সময় সরকারি নিয়ম মেনে জেনেরিক নাম লিখতে হয়। কিন্তু চেম্বারে রোগী দেখে ভাল ওষুধের নামই লিখি। অনেক সময়ে নামী সংস্থার ওষুধে দ্রুত ফল হয়। স্বাভাবিক ভাবেই একটা আস্থা তৈরি হয়।’’
এই অভিজ্ঞতা বহু চিকিৎসকেরই। শক্তিনগর জেলা হাসপাতালের এক মেডিসিনের চিকিৎসক তো বলেই ফলেন, ‘‘সস্তার তিন অবস্থা। এটা কিন্তু ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকানের ওষুধের ক্ষেত্রেও কিছুটা খাটে।’’ তাঁর মতে, সব সময় না হলেও কিছু ক্ষেত্রে নামী সংস্থার ওষুধ দিতে কার্যত বাধ্য হন চিকিৎসকেরা। বিশেষ করে প্রসূতি, হার্টের রোগী কিংবা শিশুদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে অনেক সময়েই ন্যায্য মূল্যে পাওয়া ওষুধের উপরে ভরসা রাখতে পারেন না তাঁরা।
শক্তিনগর জেলা হাসপাতালের এক শিশু বিশেষজ্ঞের কথায়, ‘‘দেখুন, লোকে দু’টি বিষয়ে খুবই স্পর্শকাতর। শিশু এবং প্রসূতি। অনেক সময়ে এমন পরিস্থিতি থাকে যে ওষুধ কাজ করতে সামান্য দেরি হয়ে গেলে ঝুঁকি হয়ে যেতে পারে। তখন আমরা রোগীর পরিবারকে ‘আনঅফিসিয়ালি’ বাইরের দোকান থেকে ওষুধ আনকে বলি। কিছু করার থাকে না।’’
বহরমপুরের শিশু বিশেষজ্ঞ ভোলানাথ আইচ বলছেন, ‘‘আমি জেনেরিক নামে ওষুধ লেখার পক্ষে। কিন্তু কিছু জটিলতা আছে। যেমন ধরুন, বাচ্চাদের সর্দি-কাশির ক্ষেত্রে একটা ওষুধ আছে যার কম্পোজিশন এত জটিল যে ফার্মাসিস্ট ছাড়া কারও পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। অধিকাংশ ওষুধের দোকানে ফার্মাসিস্ট থাকে না। ফলে জেনেরিক নাম লিখতে ভয় করে। তার চেয়ে নামী সংস্থার ওষুধ লিখে দিলে অন্তত গুণগত মান নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকা যায়।’’
সমস্যা হয় শ্বাসকষ্টের রোগীদের নিয়েও। বহু সময়েই কষ্ট কমাতে নামী সংস্থার ইনহেলার এবং নেবুলাইডার যন্ত্র কিনে আনতে বলতে হয় সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারদেরও। নইলে উপশম হতে সময় তো লাগবেই, রক্তে কার্বন ডাই-অক্সিজেনের মাত্রা বেড়ে গেলে রোগীর জীবনের ঝুঁকিও হয়ে যেতে পারে, বলছেন ডাক্তারেরা।
কিছু ন্যায্য মূল্যের দোকান অবশ্য সরকারি তালিকার ১৪২টি জীবনদায়ী ওষুধের বাইরেও অন্য ওষুধ রাখে। শক্তিনগর জেলা হাসপাতালের ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান মালিকদের দাবি, তারা প্রায় বারোশো রকমের ওষুধ রাখছে। জেলার অন্য ন্যায্য মূল্যের দোকানগুলিতেও কয়েশো করে ওষুধ মেলে। রানাঘাট, শান্তিপুর ও নবদ্বীপের দোকানগুলির মালিক অংশুমান দে-র দাবি, তাঁর দোকানে প্রায় ন’শো রকমের ওষুধ আছে।
এটাই কি সঠিক ছবি?
কল্যাণীর জহরলাল নেহেরু মেমোরিয়াল মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকানে যেমন এখন বেশির ভাগ ওষুধই পাওয়া যাচ্ছে না। দোকান মালিকেরাই বলছেন, তাঁদের কাছে প্রায় ৬০ শতাংশ ওষুধ নেই। কেন? তাঁদের দাবি, মাস দুয়েক আগে হাসপাতালই অন্তর্বিভাগে ব্যবহারের মতো প্রায় সমস্ত ওষুধ কিনে নিয়েছে, যা রোগীদের বিনা পয়সায় সরবরাহ করা হচ্ছে। ফলে ন্যায্য মূল্যের দোকানে চাহিদাও কমে গিয়েছে। তাই ওষুধ রাখা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রতি দিন বহির্বিভাগে যে শ’য়ে-শ’য়ে রোগী আসেন, তাঁদেরও তো প্রচুর ওষুধ কিনতে হয়? তাঁদের চাহিদাও ওষুধ রাখার পক্ষে যথেষ্ট নয়? সদুত্তর মেলেনি।
তবে সব কিছুর পরেও যে ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান মানুষের কাজে এসেছে চিকিৎসকেরাও মেনে নিচ্ছেন। তাঁদের বক্তব্য, অনেক রোগ আছে যা সারতে কিছু সময় লাগলেও ক্ষতি নেই। যেমন পেটের পুরনো রোগ বা চর্মরোগ। সে সব ক্ষেত্রে কম দামের ওষুধ হাতের কাছে থাকায় হতদরিদ্র রোগীরা চিকিৎসাটা অন্তত পাচ্ছেন, আগে যা তাঁদের আয়ত্তের বাইরে ছিল। ওষুধ সংস্থা, মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ, ডাক্তারদের একাংশ এবং ওষুধের দোকানে দশচক্রে আর তাঁদের ভূত হতে হচ্ছে না।
কৃষ্ণনগরের ন্যায্য মূল্যের দোকান থেকে বেরিয়ে এসে শহরেরই বাসিন্দা অনীলকুমার সাহা বলেন, ‘‘সব ওষুধ মেলে না। আজ যেমন ব্লাড প্রেশারের ওষুধ পেলেও থাইরয়েডের ওষুধটা পেলাম না। কিন্তু দাম অনেকটাই কম। যা পাওয়া যায়, সেটাই লাভ।’’