বাঁ দিকে, হবিবপুরে চলছে রথযাত্রার প্রস্তুতি। মায়াপুরের ইস্কন মন্দির।—নিজস্ব চিত্র।
সামিম বিশ্বাস, জিয়ারুল বিশ্বাস, খোকন বিশ্বাস, ডেমু বিশ্বাসদের কাঁধ থেকে বোঝা নামল। দীর্ঘ দু’মাস ধরে তাঁরা হবিবপুর ইস্কন মন্দিরের রথ তৈরির গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন। খাটাখাটনির কারণে তাঁদের মধ্যে মাত্র এক জন রোজা রাখতে পেরেছিলেন। বাকিরা পারেননি। আজ ঈদে তাঁরা মাতবেন অন্য রকম খুশিতে।
একের ধর্মস্থান তৈরি ও উদ্যাপনে অন্য ধর্মের মানুষের যোগ দেওয়ার রীতি এ দেশে বহু পুরনো। রানাঘাটের হবিবপুরে ইস্কন মন্দির তার ব্যতিক্রম নয়। নদিয়ার কোতয়ালির বাসিন্দা সামিম শেখ বলেন, ‘‘রথ তৈরি করে আমাদের খুব ভাল লেগেছে। একটা কথা সব সময়ে মাথায় ছিল, আমাদের হাতে তৈরি এই রথ হাজার-হাজার মানুষ দেখবে। ভাল হলে, সবাই প্রশংসা করলেই আমাদের আনন্দ।’’
রমজান মাস চলছিল। ধর্মপ্রাণ মুসলিমেরা এ সময়ে রোজা রাখেন। সূর্যোদয়ের আগে খাওয়া, আবার সন্ধ্যায় মগরিবের আজানের পরে ইফতার করে রোজা ভাঙা। সামিম বলেন, ‘‘রথ বানানোর কাজটা খুব খাটুনির। তাই রোজা রাখিনি। রোজ গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করেছি। বৃহস্পতিবার রাতে বাড়ি ফিরেছি।’’
হবিবপুর ইস্কন মন্দিরের অধিকর্তা শ্যামরূপ দাস ব্রহ্মচারী বলেন, ‘‘শুধু রথ কেন? এখানকার মন্দির তৈরি হয়েছে ওঁদের হাতেই। চিরকালই ওঁরা আমাদের সঙ্গে আছেন। বলা যায়, আবু তাহের মিস্ত্রি ওরফে ময়না মিস্ত্রি নিজে হাতে মন্দির তৈরি করেছেন। এখনও প্রায়ই তিনি এখানে আসেন। তাঁর বয়স হয়েছে। এখন তাঁর হাতে তৈরি ছেলেরা কাজ করছে।’’
কলকাতা থেকে মায়াপুরের মধ্যে কোনও জায়গায় বিশ্রামের জন্য একটা মন্দির তৈরির প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করতেন ইস্কনের প্রতিষ্ঠাতা আচার্য শ্রীল প্রভুপাদ। সেই ইচ্ছেরই বাস্তব রূপ হবিবপুরে ইস্কনের এই মন্দির। অতিথি আবাস গড়া হয়েছে। প্রসাদ গ্রহণের ব্যবস্থা রয়েছে। দাতব্য চিকিৎসালয় তৈরি হয়েছে। শ্যামরূপ দাস বলেন, ‘‘১৯৯৭ সালে মন্দির তৈরির সময় থেকেই রফিক শেখ এখানে কাজ করেন। মন্দিরের ভোগও গ্রহণ করেন তিনি। এমনকী মন্দিরের বারান্দায় বসে নমাজও পড়েন।’’
এ বার পুরীর রথের অনুকরণে তৈরি হয়েছে হবিবপুর ইস্কন মন্দিরের রথ। কোতোয়ালির দুর্গাপুরে শৈলেন দাসের বাড়িতে কাঠ, লোহা দিয়ে তৈরি হয়েছে ৩৭ ফুট উঁচু, ২৫ ফুট লম্বা এবং ১৮ ফুট চওড়া রথটি। সাজোনর পরে উচ্চতা হবে কমবেশি ৫০ ফুট। গত দু’মাস ধরে কমপক্ষে ১৫ জন মিস্ত্রি কাজ করে চলেছেন। শৈলেনবাবু বলেন, ‘‘পুরীর রথের অনুকরণে এই রথ তৈরির চেষ্টা করছি আমরা। আকারে ছোট করতে গিয়ে একটু সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু কারও ধর্ম নিয়ে আমাদের কোনও সমস্যা নেই।’’
হবিবপুর ইস্কনের রথযাত্রা এ বার ১৯ বছরে পা রাখল। আজ, শনিবার বিকেলে এখানকার রাধামাধব মন্দির থেকে রথে চেপে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা বিগ্রহ ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে রানাঘাট শহরের স্বাস্থ্যোন্নতি ময়দানে মাসির বাড়িতে যাবে। রথযাত্রার সঙ্গে থাকবে ট্যাবলো, পৌরাণিক কাহিনী নিয়ে তৈরি মাটির মডেল, হরিনাম সংকীর্তন-সহ বহু কিছুই। রাস্তার দু’ধারে দাঁড়িয়ে থাকা দর্শকদের মধ্যে প্রসাদ বিতরণ করা হবে। মাসির বাড়িটি তৈরি করা হয়েছে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের আদলে। দেব-বিগ্রহ সেখানে ন’দিন থাকবে। ওই ক’টি দিন চলবে নাটক, সঙ্গীত, আলোচনা, হোম। ২৬ জুলাই, রবিবার উল্টোরথে বিগ্রহ ফিরবে হবিবপুরের মন্দিরে।
হবিবপুর গৌরধাম মন্দিরের অধ্যক্ষ বৃহৎ কীর্তন দাস মহারাজ বলেন, ‘‘মাসির বাড়িতে থাকার সময় জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রাকে বিভিন্ন বেশ পরানো হবে। যেমন, বৃন্দাবন বেশ, পদ্ম বেশ, পুষ্প বেশ ইত্যাদি। দৈনিক ৫৬ ভোগ দিয়ে পুজো দেওয়া হবে। হাজার হাজার ভক্ত আসবেন। তাঁদের প্রসাদ বিতরণ করা হবে। মানুষের কাছে এই রথকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতেই পুরীর রথের অনুকরণে রথ তৈরি হয়েছে।’’
রথ গড়া দেখে তাঁরা সন্তুষ্ট?
শ্যামরূপ দাস বলেন, ‘‘যাঁরা রথ গড়েছেন, তাঁরা আর সব কিছু ভুলে কী করে ভাল রথ হবে, সেটাই ভেবে গিয়েছেন। ওঁদের উপরে কাজের ভার ছেড়ে আমরা নিশ্চিন্ত।’’ তিনি যোগ করেন, ‘‘এ প্রসঙ্গে মায়াপুরের আবু তাহের মণ্ডলের কথাও বলতে হবে। বিভিন্ন ভাবে আমাদের সাহায্য করা, মন্দির নির্মাণ থেকে শুরু করে অর্থ সংগ্রহ, এমনকী রথের মডেল তৈরির জন্য বিচুলিও তিনি জুগিয়েছেন।’’
ধর্ম নির্বিশেষে মানুষ উৎসবে যোগ দেন। রানাঘাট নাশড়াপাড়ার নৌসাদ আলি বা চাকদহ বিষ্ণুপুর হাইস্কুলের শিক্ষক রুহুল আমিন হক মণ্ডলেরা বলেন, ‘‘আমরা ওই মন্দিরে রথ দেখতে যাই। প্রসাদ নিই। রথের রশি টানি। খুব ভাল লাগে। ওখানে না গেলে সেই অনুভূতি বোঝানো যাবে না।’’ সকলের রশির টানেই আজ গড়াবে হবিবপুরের সেই রথ।