কখনও ঝমঝম, কখনও ঝিরঝির, কখনও আবার ইলশেগুড়ি। ভরা ভাদ্রের সন্ধ্যায় কৃষ্ণনগর, কল্যাণী-সহ নদিয়ার বেশ কিছু শহর জল থইথই। মিনিট তিনেকের ঝড়ে লণ্ডভণ্ড কৃষ্ণনগরের কুলগাছি ও জাভা। মুহূর্তে বদলে গেল চেনা শহর। ভোগান্তির পাশাপাশি ক্ষোভ-বিক্ষোভ, তর্ক-বির্তকে আরও ভারী হয়ে উঠল বর্ষার বাতাস।
টিপ্পনি টুইটারে
রবিবার সন্ধ্যা। দিনভর বৃষ্টি। সন্ধ্যায় কৃষ্ণনগর পোস্ট অফিস মোড়কে চেনা দায়। নৌকা নামিয়ে দিলেও দিব্যি ভাসবে। কিন্তু বৃষ্টি মাথায় ক’জন আর সেই দৃশ্য দেখার সুযোগ পেয়েছেন? কুছ পরোয়া নেই। টুইটার-ফেসবুকে সেই দৃশ্যের ছবি ও ভিডিও আপলোড করতেই ঝেঁপে পোস্ট-লাইক আর পাল্টা টুইট।
কারও টিপ্পনি, ‘‘বাহ্, এ তো উন্নয়নের জোয়ার।’’ কেউ লিখলেন, ‘‘এই নিকাশি ব্যবস্থা নিয়েই কৃষ্ণনগর পুরসভা বড়াই করে?’’ কারও আবার মোক্ষম ধাক্কা, ‘‘যাক বাবা, তাহলে পঞ্চায়েত এলাকাতেই ভাল আছি।’’ অন্তর্জালে তো বটেই বাইরেও ক্ষোভ-বিক্ষোভ কম হয়নি। হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘আরও কত বর্ষা পার হলে আমরা এমন ভোগান্তি থেকে রেহাই পাব?’’
অবরোধ জলে
জলের উপরে পানি, নাকি পানির উপরে জল?
দিনকয়েক আগেই এমন ভারী বৃষ্টিতে ভেসেছিল কৃষ্ণনগরের অরবিন্দ রোড, পল্লিশ্রী, উত্তর কালীনগর, শুকুলপাড়া, নাজিরাপাড়া, কাঠালপোঁতা, নগেন্দ্রনগরের মতো এলাকা। রবিবারের বৃষ্টিতে ফের সেই এক দশা। নিকাশি নালা উপচে জল ঢুকে গিয়েছে রান্নাঘর, শোওয়ার ঘরে।
অরবিন্দ রোডের বাসিন্দা ডলি ঘোষ জানান, জলের সঙ্গে ঢুকেছে পোকামাকড়ও। বছর দু’য়েকের নাতিকে সব সময় খাটের উপরে রেখে পাহারা দিতে হচ্ছে। জলে ভাসছে পল্লিশ্রীর কাজী নজরুল পৌর প্রাথমিক বিদ্যালয়। পড়ুয়াদের নিরাপত্তার
কথা মাথায় রেখে সোমবার শিক্ষকেরা সাত দিনের ছুটি ঘোষণা করে দিয়েছেন। স্কুলের প্রধান শিক্ষক জ্যোতিষ দাস বলছেন, ‘‘এর আগেও তিন দিন এই একই কারণে স্কুল ছুটি দিতে হয়েছিল। এ বারেও পুরসভার অনুমতি নিয়ে সাত দিনের জন্য স্কুল ছুটি দেওয়া হয়েছে।” হাঁটুজলে দাঁড়িয়েই সোমবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত অরবিন্দ রোড অবরোধ করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তাঁদের অভিযোগ, সামান্য বৃষ্টিতেই এমন হাল হয়। বার বার বলেও নিকাশির হাল ফেরাতে পুরসভা কোনও পদক্ষেপ করেনি।
ঝড় না দানো
সাকুল্যে হয়তো কয়েক সেকেণ্ড। ওইটুকু সময়ের মধ্যেই ঝড়ের তাণ্ডব দেখে হাঁ হয়ে গিয়েছে কুলগাছি ও জাভা। বৃষ্টি আর ঝড়, এই দুইয়ের সাঁড়াশি চাপে গ্রামের ভূগোলই যেন বদলে গিয়েছে। উড়ে গিয়েছে পাটকাঠির ঘর। খাবারের টিন উড়ে গিয়েছে প্রায় ৪০ ফুট দূরে। কারও ঘরের চাল গাছের ডালে, তো কারও গ্যাসের সিলিন্ডার শৌচাগারের মাথায়। সাইকেল উঠে পড়েছে বাবলা গাছে! বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে আছে রাস্তার উপরে। জেলা প্রশাসনের দাবি, কুলগাছিতে ৬৬টি ও জাভায় ৫০টি বাড়ি ঝড়ে ভেঙে গিয়েছে। তাদের জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে শুকনো খাবার। জাভায় প্রাথমিক স্কুলে সকালেই বসিয়ে দেওয়া হয় খিচুড়ি। পঞ্চায়েতের তরফে প্রাথমিক ভাবে ত্রিপল বিলি করা হয়।
নারদ নারদ
এ ভাবে জল জমছে কেন? স্থানীয় বাসিন্দারা সমস্বরে বলছেন, ‘‘বেহাল নিকাশি।’’ পাল্টা প্রশ্ন তুলছে পুরসভাও, ‘‘নিকাশি ব্যবস্থা বেহাল করছে কারা?’’ তাদের দাবি, বহু বার বলে, প্রচার করে শহরে প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করা যায়নি। আর শহরের নাগরিকদের একটা বড় অংশ কোনও কিছু না ভেবেই সেই প্লাস্টিক ফেলেন নালার মধ্য। বর্ষায় তারই ফল ভোগ করতে হয়। আর ক্ষুব্ধ বাসিন্দারা বলছেন, ‘‘আমাদের উপরে দায় চাপিয়ে পুরসভা হাত ঝেড়ে ফেলতে চাইছে। পরিকাঠামোর কোনও উন্নতি না করে শুধু সচেতনতা দিয়েই কি আর বেহাল নিকাশি ঠিক করা যায়?’’ কৃষ্ণনগরের পুরপ্রধান অসীমকুমার সাহা বলছেন, ‘‘নিচু এলাকাতে জল জমেছে। ওই এলাকায় দু’টি পাম্প চালিয়ে জল বের করে দেওয়া হচ্ছে।’’
অভয় প্রশাসনের
জেলা সেচ দফতর সূত্রে খবর, এ বছরে সব থেকে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে রবিবার। জেলায় ভাগীরথী এবং জলঙ্গি নদীর বিপদসীমা ৮.৪৪ মিটার। চরম বিপদসীমা ৯.০৫ মিটার। বর্তমানে এই দু’টি নদী বইছে ৮.৪১ মিটার উঁচুতে। প্রশাসনের দাবি, এখনই নদীর কূল ছাপিয়ে এলাকায় জল ঢোকার আশঙ্কা নেই। জেলাশাসক সুমিত গুপ্তা বলছেন, কুলগাছি ও জাভার ঝড়ের প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, ‘‘প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে এটা সাইক্লোন। একটা নির্দিষ্ট এলাকার উপর দিয়ে প্রচণ্ড বেগে বয়ে গিয়েছে। ত্রাণ নিয়ে কোনও সমস্যা নেই।”