মেডিক্যাল কলেজ চত্বরে অধীর চৌধুরীকে নিজেদের অসহায়তার কথা জানাচ্ছেন হাসপাপাতালের আয়ারা। মঙ্গলবার তোলা নিজস্ব চিত্র।
অন্তর্ঘাত না কি এসি থেকে আগুন?
সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে সিআইডি। পৃথক ভাবে তদন্ত করছে স্বাস্থ্য দফতরও। সেই তদন্তে এখনও পর্যন্ত যা উঠে এসেছে তা কিন্তু রীতিমতো চমকে ওঠার মতো!
সিআইডি ও দমকল সূত্রে জানা গিয়েছে, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে দমকল দফতরের কোনও নির্দেশই মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ মানেননি।
২০১২ সালের জুন মাসে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল চালু হয়। দু’বছর পরে, বহরমপুর দমকল দফতর থেকে চিঠি পাঠিয়ে ‘অগ্নিনির্বাপন যন্ত্র’, ‘ফায়ার স্মোক ডিটেক্টর’, ‘ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম’, ‘জলাধার’ এবং ‘আপৎকালীন দরজা’ তৈরির নির্দেশ দেয়। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তার একটিও কার্যকর হয়নি। ফলে দমকল দফতরের কাছ থেকে মেলেনি ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’!
গত শনিবার সকালে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের দোতলার একটি ঘরে আগুন লাগলে আতঙ্কিত হয়ে সকলে প্রাণ বাঁচাতে হুড়োহুড়ি করে সিঁড়ি দিয়ে নামার চেষ্টা করেন। পদপিষ্ট হয়ে মারা যান এক জন আয়া এবং রোগীর বাড়ির এক আত্মীয়। পল্লবী নামে বছর দুয়েকের এক শিশুকন্যাও মারা যায়। জখম হন ১৭ জন।
ওই ঘটনার তদন্তে বহরমপুরে আসে সিআইডি। আসেন, স্বাস্থ্যকর্রাও। ঘটনার পরের দিন ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ দলও এসে ঘুরে গিয়েছে। গত সোমবার আসেন দমকল দফতরের ডিজি সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়। ওই অগ্নিকাণ্ড নিয়ে দমকল দফতরের নদিয়া-মুর্শিদাবাদের ডিভিশন্যাল অফিসার শঙ্কর সরকার তাঁর কাছে রিপোর্টও জমা দিয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। তবে শঙ্করবাবু এ দিন বলছেন, ‘‘যেখানে সিআইডি এবং ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ দল আগুন লাগার কারণ খুঁজছে, সেখানে আমাদের রিপোর্টের কোনও গুরুত্ব আছে কী!’’
বছর দুয়েক আগে দমকল দফতর আগুন থেকে রেহাই পেতে বেশ কয়েকটি প্রস্তাব লিখিত ভাবে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল পাঠানো হয়। কিন্তু ওই প্রস্তাব মানা হয়নি বলে শঙ্করবাবু মেনে নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ত্রুটি তো রয়েছে।’’
কী সেই ত্রুটি?
দমকল দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে—১) হাসপাতালের কোথাও ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম নেই। ২) লাগানো হয়নি অ্যালার্ট বেল। ৩) অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র রয়েছে, কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। ৪) হাসপাতালে আপৎকালীন পাঁচটি দরজা রয়েছে। কিন্তু অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে সাধারণ মানুষ কোন পথে হাসপাতাল থেকে বের হবে তা চিহ্নিত করা নেই কোথাও। ৬) বিশেষজ্ঞ অধীনে অগ্নিনির্বাপণ কন্ট্রোল রুম থাকার কথা। কিন্তু তাও খোলা হয়নি।
বহরমপুর দমকল দফতরের প্রাক্তন এক অফিসার বলেন, ‘‘আগুনের হাত থেকে রেহাই পেতে হলে যে সমস্ত নিয়মকানুন মানা উচিত ছিল তার একটাও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মানেনি। ফলে কোনও দিনই ওই মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সুরক্ষিত ছিল না। এত দিন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেনি তাই ত্রুটি চোখে পড়েনি।’’
যদিও জেলার এক মাত্র মেডিক্যাল কলেজে ওই আগুন লাগার ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রী ‘অন্তর্ঘাত’ দেখছেন। তার পরেই রাজ্য সরকারের নির্দেশে ওই অগ্নিকাণ্ডের তদন্ত ভার সিআইডি নেয়। সিআইডি কর্তারা রবিবারই বহরমপুরে এসে হাজির হন। ঘুরে গিয়েছেন ফরেন্সিক দফতরও।
গোটা বিষয়টি সরজমিনে খতিয়ে দেখতে সোমবার মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আসেন দমকল বিভাগের ডিজি সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়। পৃথক ভাবে তদন্ত করতে স্বাস্থ্যভবনের বিভিন্ন কর্তা বহরমপুরে আসেন।
গত দু’দিন ধরে বিভিন্ন প্রতিনিধি হাসপাতালের যে ঘরে আগুন লেগেছে সেটি ঘুরে দেখেন। কিন্তু সুপারের ঘর থেকে সেই ‘পোড়া’ ঘরে যাওয়ার পথে হাসপাতালের কোথাও অগ্নিনির্বাপন যন্ত্র চোখে পড়েনি বলেও তদন্তকারী দল ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এমনকী ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম লাগানো হয়নি কেন? তা নিয়ে তাঁরা প্রশ্ন তোলেন। এমনকী অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটলে যাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ জলের ব্যবস্থা করার জন্য যে জলাধার নির্মাণ করতে হত, তাও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ করেনি। বিষয়টি অবশ্য তদন্তকারী দলের চোখ এড়িয়ে যায়নি।