লিঙ্ক নেই তাই কাজ বন্ধ।
বছর ছয়েকের রাকিব ও বছর দেড়েকের মাহিদ দুই ভাই। প্রায় রোজ সন্ধ্যার পর বাবার সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলে ওরা। মাহিদ কথা না বলতে পারলেও ফোনের স্ক্রিনে বাবার ছবিটা দেখেই লাফাতে শুরু করে। প্রায় সাড়ে সাত মাস বাবাকে না দেখা সন্তানেরা 'আব্বু-আব্বু' করে চেঁচিয়ে ওঠে ফোনের স্পিকারে। আর ওদের দেখার পরেই সারা দিনের হাড়ভাঙা পরিশ্রম, যাবতীয় ক্লান্তি ধুয়ে মুছে যায় শরীর থেকে।
‘‘নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ি ওদের মুখটা দেখেই।’’ কেরল থেকেই ফোনে বলছিলেন ডোমকলের ধুলাউড়ি এলাকার ইসরাইল শেখ। বলতে বলতেই তাঁর গলা কেঁপে উঠছিল। নাগাড়ে কথাগুলো বলতে বলতেই হঠাৎ করেই থেমে যাচ্ছিল ইসরাইল। কেবল ইসরাইল নয়, মুর্শিদাবাদের হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিক এখন এ ভাবেই এক বুক কষ্ট নিয়ে দিনভর পরিশ্রম করে বিছানায় শুয়ে ছটফট করছেন। বলছেন, সরাসরি দেখা না হোক। বুকে না জড়িয়ে ধরতে পারি, কিন্তু দুধের স্বাদটা ঘোলে মেটানোর মতো ফোনের স্ক্রিনে ওদের মুখটা ভেসে উঠলেই সব যন্ত্রণা মুছে যেত।
কিন্তু রবিবার থেকে সেই যন্ত্রণা মেটানোর যন্ত্রটা একেবারে অকেজ হয়ে পড়েছে। সব ঠিকঠাক থাকলেও মুর্শিদাবাদের ইন্টারনেট বন্ধ থাকার ফলে সবটাই বিফলে। ফোনে কথা বলতে পারলেও সন্তানদের মুখটা দেখতে না পেয়ে মনভার অনেক পরিযায়ী শ্রমিকের। জলঙ্গির নওদাপাড়া এলাকার পরিযায়ী শ্রমিক সমিরুল ইসলাম বলছেন, ‘‘প্রায় বছরখানেক আগে ঘর ছেড়ে এসেছি কেরলে। মা, স্ত্রী সন্তানদের সঙ্গে সেটাই ছিল শেষ সরাসরি সাক্ষাৎ। কিন্তু স্মার্টফোনের দৌলতে প্রায় রোজই তাদের সঙ্গে এক ঝলক দেখা হয়। কথা হয় সমস্ত বিষয় নিয়ে। বৃদ্ধ মায়ের সঙ্গেও প্রায় দিনই কথা বলি ভিডিও কলে। মাও হয়তো আমার মুখটা দেখে স্বস্তি পায় আমার মতোই। কিন্তু রবিবার থেকে সব বন্ধ হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ করেই এমন পরিস্থিতি হওয়ায় যেন মনে হচ্ছে চারপাশটা অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। কাজে গিয়েও মন বসছে না। ইন্টারনেট পরিষেবা যে আমাদের জীবনেও কতটা জরুরি তা আঁচ করতে পারছি এখন।’’
প্রায় সব পরিযায়ী শ্রমিকের হাতেই আছে স্মার্টফোন। আর তাঁরা ভিডিও কলে কথা বলার জন্যই প্রতি মাসে একটা নির্দিষ্ট অর্থ খরচ করেন ইন্টারনেট পরিষেবা পেতে। তাঁদের দাবি, ‘‘আমরা যে কী অবস্থার মধ্যে এখন আছি সেটা যারা আমাদের মতো হতভাগারা যারা দূর দেশে থাকে তারা ছাড়া কেউ বুঝতে পারবে না।’’
তবে কেবল কেরলে পরিযায়ী শ্রমিক নয়, উল্টোদিকে ঠিক একই ছবি দেখা যাচ্ছে মুর্শিদাবাদের গ্রামে গঞ্জে। গ্রামের মাচায় বসে ৭৮ বছরের বৃদ্ধ আব্দুল কাদের পাড়ার নেটিজেনদের কাছে বারবার জানতে চাইছেন, কখন ইন্টারনেট পরিষেবা চালু হবে। কখন তার এর্নাকুলামে থাকা একমাত্র সন্তান হাবিবুর রহমানের সঙ্গে এক ঝলক দেখা হবে। ছেলের কিনে দেওয়া দামি স্মার্টফোনটা কাদেরের কাছে এখন বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার কথায়, ‘‘এই ফোনটাই আমি কিছুই করতে পারি না। শুধু মাঝে মাঝে ছেলেটা ফোন করলে ধরতে পারি। আঙুলের ছোঁয়া লাগালেই ছেলের মুখটা ভেসে উঠে ফোনে। সেটাও ফোন কেনার পর নিজে হাতেই শিখিয়ে দিয়েছিল ছেলে। কিন্তু দিন কয়েক থেকে একেবারেই বোবা হয়ে গিয়েছে ফোনটা। কবে নেট আসবে কেউ বলতে পারছে না।’’
আর ইসরাইলের দুই সন্তান রাকিব মাহিদ তাদের আব্বুর মুখটা দেখার অপেক্ষায় বারবার হাতে তুলে নিচ্ছে স্মার্টফোন। কিন্তু আব্বুর মুখটা আর দেখা হচ্ছে না তাদের। বারবার ফোন হাতে মায়ের কাছে ছুটে যাচ্ছে, জানতে চাইছে, কখন দেখা যাবে আব্বুকে।