জঙ্গিপুর ভবনের সেই চেয়ার। এখানেই বসতেন প্রণববাবু।
রাষ্ট্রপতি হিসেবে দিল্লির বাইরে জঙ্গিপুরই ছিল তাঁর শেষ সফর। পুরনো রাস্তা, চেনা উদ্যোগেই। বাড়ি, আরও চেনা সেই সব মুখের সামনে দাঁড়িয়ে একটু আবেগই বুঝি এসে গিয়েছিল গলায়, “এ বার যখন জঙ্গিপুরে আসব তখন সাধারণ নাগরিকের মতো, এত লোকলস্কর থাকবে না!’’ ২০১৭ সালের ১৪ জুলাইয়ের সেই দিনের পরে ‘প্রাক্তন’ রাষ্ট্রপতি হয়েও ফিরে ফিরে এসেছেন তিনি। সেই ছোটখাটো মানুষটিই যে আর আসবেন না, ভাবতে চাইছে না জঙ্গিপুর।
শহরের অদূরে, দেউলি গ্রামে দাঁড়িয়ে থেকে গড়েছিলেন তাঁর ঠিকানা, ‘জঙ্গিপুর ভবন’, বাড়িটার সামনে চুপ করে আছে অন্ধকার। আশপাশের বাসিন্দারা বিকেল থেকে সে বাড়ির সামনে চাপা অস্বস্তি নিয়ে উশখুশ করছেন। যেন, বাড়ির শালুক ফোটা পুকুর, আমগাছ, সাদা দেওয়ালের কোথাও বুঝি লেপ্টে রয়েছে প্রণববাবুর স্মৃতি। ৮ বছরে জঙ্গিপুরের এমন কোনও গ্রাম নেই যেখানে যান তিনি যাননি। ঝাড়খণ্ড লাগোয়া উমরাপুরের গ্রাম থেকে বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া চর পিরোজপুর—কখনও ভোট চাইতে, কখনও সরকারি প্রকল্পের উদ্বোধনে। আর সেই সব অজ গ্রামের অনেককেই, হ্যাঁ, নামে চিনতেন তিনি। ৮ বছরের সেই রাজনৈতিক স্মৃতি ৫ বছরের রাষ্ট্রপতির অনুশাসিত জীবনযাপনে একটুও ক্ষুণ্ণ হয়নি। বার বারই বলতে শোনা গিয়েছে তাঁকে, ‘‘আরে, এই কাছের মানুষগুলোকে ভোলা যায়। ওঁদের জন্যই তো আমি মন্ত্রী হয়েছি। ওরাই আমাকে দিল্লি পাঠিয়েছে এতগুলো বছর ধরে।’’ তাঁদের জন্য জঙ্গিপুর তো বটেই দিল্লির বাড়ির দরজাও কখনও বন্ধ হয়নি। ২০০৪ সালে জীবনের প্রথম সফল নির্বাচনে জঙ্গিপু্রে লড়তে এসে যার বাড়িতে ডেরা বেঁধেছিলেন সেই মুক্তি ধরের বাড়ি এখন তৃণমূলের ঘাঁটি। পরে সে বাড়ি ছেড়ে শহরের ভাড়া বাড়িতে উঠে গেলেও যখনই এসেছেন মুক্তির জন্য মিষ্টি নিয়ে এসেছেন। দিল্লিতে জঙ্গিপুরের পরিচয় নিয়ে কেউ গেলেও সময় দিয়েছেন তাঁকেও। অকাতরে চিকিৎসার ব্যবস্থা করিয়ে দিয়েছেন। এমনকি থাকার জায়গা না থাকায়, সে ব্যবস্থাও করেছেন জঙ্গিপুরের এক প্রবীণের।
ঝাড়খণ্ড লাগোয়া সুতির বহুতালির প্রবীণ কর্মী সাকুয়াত আলির অসুস্থতার খবর পেয়ে ছুটে গেছেন তার বস্তি বাড়িতেও। কৃষ্ণশাইল গ্রামে দলের কর্মী পঞ্চায়েত প্রধানের বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে আশীর্বাদ করে এসেছেন দম্পতিকে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিসেবে তাঁর হাত ধরেই রেলের উড়ালপুল পেয়েছে মিঞাপুর, কলেজ পেয়েছে সাগরদিঘি। প্রায় ৪০ কোটি টাকায় সুতিতে রাস্তা গড়ে উঠেছে তাঁর বরাদ্দ করা টাতাতেই।
শেষ সফরে জঙ্গিপুরে এসে সদরঘাটে ভাগীরথী লাগোয়া সবুজ দ্বীপে যেতে চেয়েছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। সবুজ দ্বীপের পাশেই ভাগীরথী। চেয়েছিলেন নদীর পাড়ে বিকেলে কিছুটা সময় কাটিয়ে যাবেন। সেদিন বড়দিনের ছুটিতে প্রচণ্ড ভিড় ছিল পিকনিকে আসা মানুষ জনের। নিরাপত্তার বেড়াজালে দেখা হয়নি সেদিন তার সবুজ দ্বীপ। ২০১৮ সালের ২৪ ডিসেম্বর শেষবারের জন্য ৪ দিনের সফরে এসেছিলেন জঙ্গিপুরে। তার জঙ্গিপুরের বাসভবনে শয়ে শয়ে পরিচিত মানুষজনের ভিড় আছড়ে পড়েছিল সেই ক’দিনে। তার সঙ্গে ছবি তোলার হিড়িক পড়েছিল সেদিন। ফেরাননি কাউকেই। হাসি মুখে শুধু সঙ্গ দিয়ে গেছেন।
নিজের বাড়িতে এত খোলা মনে সচরাচর কখনও পাওয়া যায়নি প্রণববাবুকে। বার বার অনেকেই তুলেছিলেন রাজনীতির প্রসঙ্গ। সেসব এড়িয়ে প্রণববাবু জানিয়ে ছিলেন “আমি এখন কোনও রাজনীতির লোক নই। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর সে রাজনৈতিক সত্তা শেষ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু মানুষ যেমন অতীতকে ভুলতে পারে না, তেমনই আমি আমার জঙ্গিপুরের রাজনৈতিক শিকড়কে কখনও ভুলতে পারব না।” বলে গিয়েছিলেন, “সাংবাদিকেরা বলতেন আমি রুট লেস। জঙ্গিপুর আমাকে সেই রাজনৈতিক শিকড় দিয়েছে।’’