সীমান্ত লাগোয়া গ্রামীণ ডোমকল রাতের আকাশে এখনও ফুরলঝুরি দেখে, ঠাঠা আকাশে মেঘের গর্জনও শোনে!
চমকে চমকে ওঠেন হৃদরোগীরা, ঘুম ভেঙে ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসার পর থেকে বাকি রাত আর ঘুম আসে না। গ্রামের এ কোনায় সেকোনায় বোম পড়ে অনর্গল।
এ ভাবেই আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন মোশারফ হোসেনের বাবা। মোশারফ বলছেন, ‘‘বাবাকে নিয়ে গ্রামে বাস করলে বেশি দিন বাঁচাতে পারব না, তাই সিদ্ধান্ত নিলাম বাবাকে বাঁচাতে হলে গ্রাম ছাড়তে হবে।’’
কেবল মোশারফের পরিবার নয়, গ্রাম ছেড়েছেন ওলিউল ইসলাম বিশ্বাস, আমিরুল ইসলামের মতো আরও অনেকেই।
কিন্তু কুচিয়ামোড়া বরাবরই এমন? ব্যবসায়ী ওলিউল বলছেন, ‘‘সেই কোন ছেলেবেলা থেকে বাড়ির বড়দের কাছ থেকে শুনে আসছি গ্রাম খুব শান্ত ছিল। গ্রামে সবাই মিলেমিশে থাকত। বিকেল হলেই পঞ্চায়েতের মাঠে খেলা। সবুজ ঘাসে আড্ডা।’’ মোশারফের দাবি, ‘‘এক সময় গ্রামের পঞ্চায়েত ভবনের সামনের মাঠে নিয়মিত ভলিবল খেলা হত। আমি ছিলাম সেই ভলিবল দলের ক্যাপ্টেন। এখনও মনে আছে আশপাশের গ্রামের মধ্যে আমরা ছিলাম ভলিবল চ্যাম্পিয়ন দল। আর এখন, ভলিবল থেকে বোমা-গুলিতে চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেলাম!’’ কেবল খেলা নয়, গ্রামবাসীরা বলছেন, ‘‘সংস্কৃতির চর্চার দিক থেকেও গ্রাম ছিল এগিয়ে। পঞ্চায়েতের মাঠের সামনে গড়ে ওঠে স্থায়ী পাকা মঞ্চ। সেই মঞ্চ থাকলেও সংস্কৃতির চর্চা নেই। এখন কুচিয়ামোড়া গ্রামে চর্চা বলতে একটাই, বোমা আর গুলির লড়াই। গ্রামের মানুষ একে-অপরকে বিশ্বাস করতে পারেন না। গ্রাম জুড়ে অবিশ্বাসের হাওয়া।
কেন এমন বদলে গেল গ্রাম? গ্রামবাসীদের দাবি, মূলত কংগ্রেসের জমানা শেষে হয়ে যাওয়ার পরে বাম আমলে গ্রামের বর্ধিষ্ণু পরিবারগুলো শ্রেণীশত্রুর তকমা পায়। তাঁদের উপরে বিভিন্ন ভাবে আক্রমণ নেমে আসে। কখনও বাড়ি লুট, কখনও ফসল লুটের নামে রাজনৈতিক গণ্ডগোল শুরু হয়ে যায় গ্রামে। তার পর থেকে সেই গণ্ডগোল থামেনি। ১৯৮৫ সালের পর থেকে গণ্ডগোল চরম আকার নিয়েছিল। ১৯৯১ সালে একই দিনে খুন হন ৫ জন গ্রামবাসী। তার পর থেকেই শান্ত কুচিয়ামোড়া কখন যেন অশান্ত-গ্রাম হয়ে ওঠে। পড়শি গ্রামের মানুষও ভয় পেতে শুরু করেন কুচিয়ামোড়াকে। এমনকি সেই গ্রামে বিয়ে দিতেও রাজি হতেন না অনেকে। সেই রেওয়াজ এখনও চলছে। এখন তাই অন্য গ্রামের মানুষ জন আত্মীয়তা করতে ভয় পান কুচিয়ামোড়ার সঙ্গে। বিয়ের কথা পাকা করার পরেও বোমার শব্দ ভেঙে দিয়েছে সে বিয়ের স্বপ্ন!