যেন তরতরিয়ে বাড়ছে আমের চারাটা। উঠোনের ঠিক মাঝখানটায়। রোজ নিয়ম করে গোড়ায় গোবর সার আর জল দেন যে চাঁদুবালা ঘোষ।
নিজের হাতে চারা পুঁতে গিয়েছিল ছেলেটা। ঘরের পাশে লাইন দিয়ে কয়েকটা আনারস গাছ। পরের বার এসে আনারস পেড়ে খাবে— বলে গিয়েছিল ছেলেটা।
কথা বলতে-বলতে চুপ করে যান মাওবাদীদের হাতে নিহত কোবরা বাহিনীর জওয়ান দীপক ঘোষের মা চাঁদুবালা। তার পরে ফের বলেন, “ছেলে যে আর মা বলে ডাকবে না, কিছুতেই বিশ্বাস হয় না। কেবলই মনে হয়, এই বুঝি বাড়ির সকলের জন্য পুজোর বাজার করে নিয়ে আসবে। বলবে— কী, পছন্দ হয়েছে মা?”
ছেলের ব্যবহার করা জিনিসপত্র যত্ন করে গুছিয়ে রাখেন এখনও। আঁচল দিয়ে মুছে রাখেন সেই জুতো, চাকরি পাওয়ার আগে দীপক যেটা পড়ে জুতো পড়ে মাঠে ছুটতে যেত। বছর সাতেক আগে সিআরপিএফ-এ যোগ দিয়েছিল চাপড়ার জামরেডাঙার দীপক। বছর দুয়েক আগে কোবরা বাহিনীর প্রশিক্ষণ শেষ হয়। তার পরে বিয়ে। মাঝেমধ্যে ছুটিতে বাড়ি আসা। গ্রাম জুড়ে তখন হইচই। শেষ পোস্টিং ছিল গয়ায়। দু’দিন আগেই তাদের ২০১ নম্বর কোম্পানির ডিউটি পড়েছিল বিহারের অরঙ্গাবাদে। রাতে মাওবাদীদের খোঁজে গিয়ে মাইনে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় তাঁর দেহ।
দীপকের বাবা নেপাল ঘোষের মূল পেশা ছিল দিনমজুরি। নিজস্ব জমি বলতে ছিল মাত্র বিঘে দেড়েক। দুই ছেলে, দীপক ছোট। মাধ্যমিক দেওয়া পর থেকে গ্রামের পাশে ফরেস্ট মাঠে সকাল-বিকেল দৌড়েছে। আর পাশে জলঙ্গী নদীতে টানা এক ঘণ্টা করে সাঁতার। ঝড়-জল-বৃষ্টি কোনও কিছুই তাঁকে থামাতে পারেনি।
বাবার মৃত্যুর কিছু দিনের মধ্যেই চাকরিতে ডাক পায় দীপক। কাঁচা ঘর পাকা হয়। বিয়ের পরে পাশে একটা আলাদা বাড়িও করেছিলেন আগেরটা দাদাকে ছেড়ে দিয়ে। ছাদ ঢালাই হয় যে দিন, সে দিনই দীপকের মৃত্যু হয়। সেই থেকে ওই ভাবেই পড়ে আছে। দরজা-জানালা খোলা। পাল্লা বসেনি। দীপকের স্ত্রী এখন আর এখানে থাকেন না। যোগাযোগও নেই।
দীপকের দাদা রমেশের মনে পড়ে, গত বারও সকলের জন্য পুজোর বাজার করে এনেছিল। তিন ভাইপো- ভাইঝি ছিল প্রাণ। তাদের নিয়ে ঠাকুর দেখতে বেরোনো থেকে বন্দুক-ক্যাপ কিনে দেওয়া।
বাচ্চারা কি মৃত্যু বোঝে? কতটা বোঝে? ‘মাওবাদী’ মানে তাদের কাছে কী? বছর আটেকের সৌরভ বারবার শুধু প্রশ্ন করে, “ঠাম্মা কাকাইকে ওরা মারল কেন?”
ঠাম্মা উত্তর দেন না। তিনিও যে একই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন।