দুর্ঘটনাগ্রস্ত বাসটির যাত্রী
রমজান মাস ছিল বলে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলাম।
এখনও মনে পড়ে ১৯৯৮ সালের সেই ১৩ জানুয়ারি। গৃহশিক্ষকের সঙ্গে পিকনিক করতে গিয়েছিলাম বাসে করে। হাড় হিম করা পদ্মার জলে পড়ল সেই বাস। ঠান্ডা জলে দমবন্ধ হয়ে আসছিল। বারবার মনে হচ্ছিল, জীবনের শেষ সময়ে পৌঁছে গিয়েছি। কোনও ক্রমে খাবি খাওয়া মাছের মতো করে পাড়ে যখন পৌঁছলাম, তখন এলাকার লোকজন সেখানে পৌঁছে গিয়েছেন। তাঁরাই আমাদের উদ্ধার করলেন। রমজান মাস চলছিল বলে অনেকেই ভোরে উঠেছিলেন। তাঁরাই বাস দুর্ঘটনার শব্দ পেয়ে ছুটে এসেছিলেন। না হলে অমন শীতের ভোরে সে দিন আমাদের উদ্ধার করার মতো কাউকে পাওয়া যেত না।
ভয়ে আর শীতে কিছু ক্ষণের জন্য সংজ্ঞা হারিয়েছিলাম। চোখ খুলে দেখলাম, কিছু অচেনা মহিলা আমার গায়ে মায়ের মতো করে তেল মাখাচ্ছেন। আগুনের হাত-সেঁক দিচ্ছেন গালে মুখে। কেউ আবার গরম দুধের গ্লাস নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন মুখের সামনে। তাঁদের জন্যই জীবন ফিরে পেয়েছিলাম।
কিছু ক্ষণ পরে হইচই আর আর্তনাদে বুঝলাম কত বড় দুর্ঘটনায় পড়েছিলাম। কিছু ক্ষণ পরে নিয়ে যাওয়া হল হাসপাতালে, সেখান থেকে সুস্থ হয়ে ঘরে ফেরা। কিন্তু এখনও ১৩ জানুয়ারি এলে সে দিনের মতোই হাড় হিম হয়ে যায়। চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই স্যার, বন্ধুদের মুখ। চেষ্টা করি ভোলার, কিন্তু হয় কোথায়!
তখন আমি করিমপুর পান্নাদেবী কলেজে একাদশ শ্রেণিতে পড়ি। করিমপুরের গৃহশিক্ষক সনাতন দে-র কাছে পড়তাম। সব ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে মুর্শিদাবাদের লালবাগে পিকনিক করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সেই মতো ১২ জানুয়ারি সকালে প্রায় ৮২ জন ছাত্রছাত্রী একটি বাস ভাড়া করে রওনা দিয়েছিলাম লালবাগে। লালবাগ থেকে গভীর রাতে ছেড়েছিল আমাদের বাস। ঘন কুয়াশায় ঢাকা রাস্তায় হাত কয়েক দূরেও দেখা যাচ্ছিল না কিছু। বাসের প্রায় সব যাত্রী তখন ঘুমের দেশে। চালকের খুব কাছাকাছি থাকায় চোখ বন্ধ হয়ে আসলেও ঘুম হয়নি। ফলে ঠিক যে সময় দুর্ঘটনায় পড়ি, আমি বিপদটা আঁচ করতে পেরেছিলাম। ঘটনার সময় বাসটির সামনের কাচ ভেঙে যায়। আমরা জনা কয়েক বন্ধু অভিশপ্ত সেই ভোরে বেঁচে গিয়েছিলাম। যাঁদের হারিয়েছি, তাঁদের মুখগুলো এখনও চোখের সামনে ভাসে।
দুর্ঘটনাগ্রস্ত বাসটির যাত্রী