মাঠের কাজে ব্যস্ত সাকিরুল শেখ। — নিজস্ব চিত্র
বাবা পেশায় দিনমজুর। পড়াশোনা চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত। মায়ের তা-ও নয়, একেবারেই নিরক্ষর। সেই বাড়িরই ছেলে কি না ৮৬ শতাংশ নম্বর পেয়েছে মাধ্যমিকে!
তেহট্ট থানার শ্যামনগরের আসরফপুরের বাসিন্দা সাকিরুল শেখ মাধ্যমিক পরীক্ষায় স্থানীয় সিদ্ধেশ্বরী ইন্সটিটিউশনে প্রথম হয়েছে। ৭০০তে সে পেয়েছে ৬০৪। বিস্ময়ের ঘোর কাটছে না সাকিরুলের মা-বাবারই।
একই সঙ্গে ছেলের এ হেন সাফল্যে দুশ্চিন্তায় ঘুম আসছে না রাতে। পড়াবেন কী করে ছেলেকে! সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরনোর দশা। পড়াশোনা সেখানে বিলাসিতা। কিন্তু মাধ্যমিকে এত ভাল ফলের পরে ছেলের পড়া বন্ধ করে হাতে নিড়ানি ধরিয়ে দেবেন! তা-ও তো মন মানতে চাইছে না।
নিজেরা কেউ স্কুলের গণ্ডি পেরোতে পারেননি। ছেলেটা অন্তত অনেক পড়াশোনা করুক, সেটাই চান সমীর শেখ। কিন্তু সাধ থাকলেই কি সাধ্য থাকে! বড় মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। আরও একটি মেয়ে আছে। ছোট, সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। ‘‘ওর কথাও তো ভাবতে হবে’’, বললেন তিনি। এত দিন টালির ছাউনি দেওয়া ঘরে থাকতেন। সম্প্রতি বিপিএল তালিকায় ইন্দিরা আবাস যোজনার একটি ঘর জুটেছে কপালে। সেই একটি মাত্র ঘরে চার জনের সংসার।
সমীরবাবুর কথায়, “দিন মজুরি করে চার জনের সংসার কোনও মতে চলে যায়। কিন্তু এক দিন কাজে না গেলে উনুনে হাড়ি চড়ে না। সে যতই শরীর খারাপ হোক না কেন।’’ বললেন, ‘‘এ বাড়ির ছেলের পড়াশোনা তো বিলাসিতার মতো। মাঝে পড়া ছেড়ে দিয়ে আমার সঙ্গে কাজ করতে বলেছিলাম ওকে। কিন্তু ছেলের এক জেদ। নিজের জেদেই পড়াশোনাটা চালিয়ে যাচ্ছে। বড় হয়ে ছেলের চাকরি করার ইচ্ছে। কিন্তু সেই স্বপ্ন কতটা সম্ভব হবে জানি না।”
মা বেদনা বিবি জানালেন, তিনি লেখাপড়া কিছুই জানেন না। স্বামী যেহেতু চতুর্থ শ্রেণি অবধি পড়েছেন, নিজের নামটা লিখতে পারেন। কিন্তু ওই পর্যন্তই। তাই গোড়া থেকেই ছেলেকে পড়ার জন্য বাড়ির কেউ কোনও সাহায্য করতে পারিনি। এর মধ্যেই বাবার সঙ্গে কাজে যেতে হয়। কখনও কোদাল, নিড়ানি নিয়ে মাঠে, আবার কখনও কলার হাটে। ‘‘কত দিন ভাত না খেয়েই স্কুলে গিয়েছে। তবুও মুখে কোনও অভিযোগ শুনিনি। বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার দূরে স্কুল। হেঁটে গিয়েছে। নয়তো বন্ধুদের সাইকেলে। তবে এখন স্কুল থেকে সাইকেল পাওয়ায় সুবিধে হয়েছে। তবে এ বার কী ভাবে ওকে পড়াবো, তা ওপরওয়ালাই জানে।”
সাকিরুলের স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কুমারেশ বিশ্বাসের কথায়, “প্রথম দিকে ও পড়াশোনায় খুব ভাল ছিল না। কিন্তু যত উচু ক্লাসে উঠেছে, তত ওর পড়ার প্রতি ঝোঁক বেড়েছে। কাজের জন্য নিয়মিত ক্লাসে না আসতে পারলেও শিক্ষকদের পড়া মন দিয়ে শুনত। বেশি টিউটর ছাড়া ক্লাসে মন দিয়ে পড়াশোনা করেও যে ভাল রেজাল্ট করা যায়, সাকিরুল তা দেখিয়ে দিল। ওকে সব রকম সাহায্য করা হবে।” সাকিরুলের কথায়, “আমাদের বাড়িতে টিভি কিংবা মোবাইল ফোন নেই। তাই কাজের শেষে বাকি সময়টা বই পড়তাম। সেই পড়াটাই কাজে লেগেছে। ভবিষ্যতে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতে না পারি, বাবা-মাকে সাহায্য করতে অন্তত একটা চাকরি পাওয়া দরকার। সেই সুযোগটা পেলেই যথেষ্ট।”