আগে আর এখন— কে ভাল, আর খারাপটাই বা কে?
বিরোধটা নতুন নয়। অতীত-সাম্প্রতিকের সেই ছায়া পড়ে নির্বাচনের দেওয়ালেও। ছায়া পড়ে ভোটের সান্ধ্য প্রচারের স্লোগানেও।
পুরনোরা মনে করেন, সেই বেশ ভাল ছিল। কখনও বা স্লোগানের হুঙ্কারে হারিয়েও য়ায় সেই অতীত।
ব্যক্তি আক্রমণের অস্ত্রে সাম্প্রতিক কালের ভোট প্রচার যেন ভয়ানক নরক-গুলজার। বিরোধী নেত্রীকে ‘পশ্চাতদেশ’ দেখানোর জন্য যেখানে স্পষ্ট নির্দেশ থাকে দলীয় অনুগামীদের কাছে। পাল্টা আস্ফালন আসে— ‘গুণ্ডা কন্ট্রোল’ করার। ‘কালীঘাটের ময়না সত্য কথা কয় না’ বলে ঠেস দেওয়ার কয়েক মাস না কাটতেই সেই ‘ময়না’র ভক্ত সেজে, ডিগবাজি খেতেও দেখা গিয়েছে অনেককে।
জীবনের উপান্তে এসে সে সব কথাই বিড় বিড় করেন ইতিহাস গবে ষক বিজয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। বলছেন, ‘‘ভোট প্রচারের এমন কদর্য পরিণতি দেখে বাস্তবিকই অসুস্থ বোধ করি।’’ ১৯৫২ সালের প্রথম নির্বাচন থেকে ভোট দিচ্ছেন তিনি। মুর্শিদাবাদ জেলায় প্রচারে আসা জাতীয় নেতাদের অনেকের বক্তৃতা তিনি শুনেছেন। তিনি বলেন, ‘‘রাজনৈতিক ভাষণের নামে এখনের মতো অশালীন ও অশ্রাব্য কথা আগে কখনও শুনিনি। এ তো এক রকম খিস্তি খেউড়।’’ তিনি মনে করতে পারেন— দেশ সদ্য স্বাধীন হয়েছে। নবগ্রাম বিধানসভার তখন প্রার্থী অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির বীরেন রায়। সিপিএমের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বেশ কয়েক বার নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী জেলা কংগ্রেসের প্রধান স্থপতি দুর্গাপদ সিংহ। স্মৃতি হাতড়ে বিজয়বাবু বলেন, ‘‘নবগ্রামে ভোট প্রচারের জনসভায় দুর্গাপদবাবু প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করে বলেন, ‘এ দেশের কমিউনিস্টরা বড় মুখ করে রাশিয়ার কথা বলেন। কনকনে ঠাণ্ডার দেশ। অথচ শীত নিবারণের জন্য সে দেশের অধিকাংশ মানুষের গায়ে পোশাক জোটে না।’ ব্যক্তি আক্রমণ বহু দূরের কথা, তিনি প্রতিপক্ষ প্রার্থীর নাম পর্যন্ত মুখে আনেননি।’’
দিন কয়েক পরে, নবগ্রামের ওই মাঠেই বীরেন রায় প্রচার করতে আসেন জ্যোতি বসু। বিজয়বাবু বলেন, ‘‘দুর্গাপদবাবুর বক্তব্যের পাল্টা জবাব দিতে জ্যোতিবাবু বলেন, ‘দুর্গাবাবু বহুদিনের রাজনীতিবিদ। কিন্তু তিনি রাশিয়ায় যাননি। আমি গিয়েছি। তিনি ঠিকই বলেছেন। সত্যিই সেখানে খুব ঠাণ্ডা। কিন্তু কারও শরীরে পোশাক নেই এমন তো দেখিনি। অথচ আমি দেখতে পাচ্ছি, আপনারা যাঁরা এখানে আছেন তাঁদের পায়ে তো জুতো নেই।’ শ্রোতারা নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে ঘাড় নাড়তে থাকেন।’’
বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্রে ১৯৫২ সাল থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আমৃত্যু সাংসদ ছিলেন আরএসপি-র প্রতিষ্ঠাতা নেতা ও স্বাধীনতা সংগ্রামী ত্রিদিব চৌধুর। ১৯৫২ সালে তাঁর বিরুদ্ধে কংগ্রেসের প্রার্থী নলীনাক্ষ সান্যাল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কিন্তু পরের বার ১৯৫৭ সালের নির্বাচনে ত্রিদিববাবুর বিরুদ্ধে কংগ্রেসে প্রার্থী দেবে না বলে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু।
জিয়াগঞ্জ কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বিষাণ গুপ্ত মুর্শিদাবাদ জেলার রাজনৈতিক ইতিহাসের গবেষকও। বিষাণবাবু বলেন, ‘‘গোয়ামুক্তি আন্দোলনে নেতৃ্ত্ব দিয়ে ত্রিদিববাবু গোয়ার জেলে কয়েক মাস বন্দি ছিলেন। অবশেষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে গোয়া স্বাধীন হয়। সেই সম্মানে ১৯৫৭ সালে ত্রিদিববাবুর বিরুদ্ধে কংগ্রেস প্রার্থী দেয়নি।’’
সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি সমন্বয়ের অন্যতম পথিকৃৎ ও স্বাধীনতা সংগ্রামী রেজাউল করিম একদা প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতিত্ব করেছেন। ১৯৭১ সালে বহরমপুর লোকসভা থেকে কংগ্রেসের হয়ে তিনি ত্রিদিববাবুর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। বিজয়বাবু বলেন, ‘‘নিজের নির্বাচনী জনসভায় ভাষণ দিতে উঠে রেজাউল করিম বলেছিলেন ঢাকু (ত্রিদিব চৌধুরীর ডাকনাম) বড় ভাল ছেলে। ঢাকু জিতলেও আমি খুশি হব।’ ভোট প্রাচারের সেই দিন এখন ইতিহাস।’’ শুধু তাই নয়, তিনি যোগ করেছিলেন, ‘‘আপনারা মনে করলে ঢাকুকেও ভোট দিতে পারেন, আবার আমাকেও ভোট দিতে পারেন!’’
মুর্শিদাবাদ জেলা থেকে লোকসভার ভোটে ‘প্রজা সোসলিস্ট পার্টি’ সমর্থিত নির্দল প্রার্থী হয়ে সৈয়দ বদরুদ্দোজা একাধিক বার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। ভোট প্রচারের পাশাপাশি তিনি স্বদেশ প্রেমেরও প্রচার করেছেন। মুর্শিদাবাদ জেলার ইতিহাস ও সমাজতত্ত্বের গবেষক খাজিম আহমেদ জানান, সৈয়দ বদরুদ্দোজার ভাষণে নানা প্রসঙ্গের সঙ্গে ঘুরে ফিরে আসত দেশ ভাগের প্রসঙ্গ। খাজিম বলেন, ‘‘প্রচারে এসে তিনি বলতেন, ‘দেশ ভাগের জন্য দায়ি কংগ্রেস। জন্মভূমিকে ভালবেসে যাঁরা পাকিস্তানে যায়নি তাঁদের নিরাপত্তা, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের কথা ভাবে না কংগ্রেস। তবুও আপনাদের বলব, বিদেশের সোনাঝরা মাটির থেকে পূণ্যস্থান স্বদেশের মাটি। আপনাদের কথা আমি লোকসভায় তুলে ধরব। আপনার ভুল করেও স্বদেশ ত্যাগ করবে না।’’
পেরিয়ে গিয়েছে সাড়ে ছ’দশক। বদলে গিয়েছে সেই সব সৌজন্য, হারিয়েছে ভাতৃত্ব-মমতার ছায়া। পুরনো মানুষেরা এখনও সেই ফেলে আসা সৌজন্যের সুরেই বলনে, ‘‘এখন একটু বদলে গিয়েছে কিনা দিন কাল। হয়তো তার সঙ্গে খাপ খাওয়াতেই বদলে দিতে হয়েছে হালের ভোটের ভাষণ-স্লোগানের ভাষা-রীতি!’’