—ফাইল চিত্র।
করিমপুর দিয়ে শুরু হয়েছিল, এ বার ভোট নেমে এল নদিয়ার মূল প্রাঙ্গণে। আজ, সোমবার কৃষ্ণনগর ও রানাঘাট কেন্দ্রে ১৮ জন প্রার্থীর ভাগ্য নির্ধারণ করবেন প্রায় ৩৫ লক্ষ ভোটার। আগামী রবিবারের জন্য বাকি থাকবে শুধু বনগাঁ কেন্দ্রে পড়া কল্যাণী, হরিণঘাটা ও চাকদহের একাংশ।
প্রস্তুতি পর্ব জুড়ে নাটকের উপাদান কম ছিল না। কৃষ্ণগঞ্জে নিহত বিধায়ক সত্যজিৎ বিশ্বাসের স্ত্রীকে রানাঘাটে তৃণমূলের প্রার্থী করা থেকে ওই কেন্দ্রে বিজেপির প্রার্থী দেওয়া নিয়ে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত টানটান উত্তেজনা। মোদী-দিদি দ্বৈরথ এবং তাহেরপুরে মোদীর সভায় ভেঙে পড়া ভিড়। কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ঝাঁটা হাতে তাড়া করার পরামর্শ দেওয়ায় তৃণমূলের মন্ত্রী রত্না ঘোষ করকে নির্বাচন কমিশনের শো-কজ়। আবার তৃণমূল প্রার্থীকে ব্যক্তি আক্রমণ করায় বিজেপির জেলা নেতা জগন্নাথ সরকারের প্রচারে নিষেধাজ্ঞা। এবং প্রায় হারিয়ে যেতে বসা বামেদের সভায় চোখে পড়ার মতো ভিড়।
মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত। প্রশ্ন দুটো। এক, প্রতিটি বুথে ভোটারেরা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারবেন কি? দুই, তাঁরা কাকে ভোট দেবেন? নোট বাতিল, জিএসটি, নিরাপত্তা বা কর্মসংস্থানের মতো বুনিয়াদি বিষয়ের পাশাপাশি কতটা প্রভাব ফেলতে পারে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি ও হিন্দুত্বের ইস্যু?
পঞ্চায়েত ভোটে নদিয়া জেলার বিস্তীর্ণ অংশের মানুষ ভোট দিতে পারেননি। পঞ্চায়েতের পর পঞ্চায়েতে বিনা যুদ্ধে ক্ষমতা দখল করেছে তৃণমূল। ফলে গ্রামাঞ্চলে বহু এলাকায় ভোটারের মন রাজনৈতিক দলগুলির অজানা। সেই সব এলাকার মানুষ কী ভাবছেন, পঞ্চায়েতে ভোট দিতে না-পারার ক্ষোভ তাঁরা লোকসভা ভোটের ইভিএমে উগরে দিতে পারেন কি না, সেই প্রশ্নও থাকছে।
ইতিমধ্যেই বিজেপির তরফে জেলা প্রশাসন ও নির্বাচনী পর্যবেক্ষকদের কাছে অভিযোগ করা হয়েছে যে, বেশ কিছু জায়গায় আগে থেকেই সন্ত্রাসের পরিস্থিতি তৈরি করেছে তৃণমূল। বিশেষ করে চাপড়া ও নাকাশিপাড়ার কিছু এলাকায় হুমকি ও অশান্তির আশঙ্কার কথা জানানো হয়েছে। যদিও তৃণমূল সব অভিযোগই অস্বীকার করছে। পুলিশ-প্রশাসনের কর্তারাও দাবি করছেন, সর্বত্রই পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে।
গত লোকসভা ভোটের চেয়ে এই নির্বাচন আলাদা অন্তত দু’টি জায়গায়। প্রথমত, প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বামেদের বদলে বিজেপির উঠে আসা। দ্বিতীয়ত, নরেন্দ্র মোদী এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কেউই এখন আর তাঁর পদে নতুন নন, ফলে প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাওয়াও বিলকুল হাজির। ২০১৪-র লোকসভা ভোটে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার খোয়াব সম্বল করে উড়ে এসেছিলেন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী মোদী। রাজ্যের তখ্তে মমতার তখন সবে তিনটি বছর কেটেছে। ফলে কারও জামাতেই কালির ছিটে তেমন ছিল না। এ বার কিন্তু দুই তরফেই তা আছে।
দুই মিলিয়ে টানটান প্রতিযোগিতা। প্রার্থীরা মুখে যে যাই বলুন, সকলেই জানেন, লড়াইটা হাড্ডাহাড্ডি। একে তো রানাঘাট কেন্দ্রে মতুয়া ভোট এবং কৃষ্ণনগর কেন্দ্রে সংখ্যালঘু ভোটের ভাগাভাগি নির্ণায়ক হয়ে উঠবে। সেই সঙ্গে আছে নতুন ভোটারদের মর্জি, যার একাংশ ‘জোশ’-এর মোহে ঈষৎ বিজেপির দিকে ঝুঁকে আছে ঠিকই, কিন্তু বাকিটা অজানাই।
এবং এই জায়গায় দাঁড়িয়ে অন্যতম নির্ণায়ক হয়ে যেতে পারে বামেদের ভূমিকা। আগের বার সদ্য ক্ষমতাচ্যুত বাম যতটা ম্রিয়মাণ হয়ে ছিল, এ বার অন্তত প্রচারে তাদের তুলনায় খানিক চাঙ্গা দেখিয়েছে। তারা যদি নিজেরা জিততে না-ও পারে, জেতা-হারার হিসেব অবশ্যই পাল্টে দিতে পারে। বিশেষ করে কৃষ্ণনগর কেন্দ্রে যেখানে ৩৭ শতাংশ মুসলিম ভোটের উপরে অনেকটাই নির্ভর করছে তৃণমূল। ক্ষুব্ধ সংখ্যালঘুদের কিছু ভোট যদি বামের কাছে ফিরে আসে তা হলে তৃণমূলের জেতা যেমন কঠিন হবে, বাম ভোট ভাঙাতে না পারলে বিজেপির বিশেষ আশা থাকবে না। কংগ্রেস শক্তিক্ষয় করতে-করতে প্রায় ৬ শতাংশে নেমে এসেছে। কিন্তু কৃষ্ণনগরে মুসলিম প্রার্থী যদি সংখ্যালঘু ভোটের কিছুটা টেনে নেন, তা হলে হিসেব আরও জটিল হবে।
কিন্তু সে সব তো পরের কথা। ভোট তো আগে শান্তিতে মিটুক!