পরিক্রমাকে ঘিরে বছরভর লক্ষ্মীলাভের আশা নবদ্বীপে

তেরো পার্বণের শহর নবদ্বীপ। পার্বণ নিয়েই বাঁচে হাজার বছরের প্রাচীন এই জনপদ। এই শহরের ভাল-মন্দের সঙ্গে উৎসবের সম্পর্ক নিবিড় এবং গভীর। বৈশাখ থেকে চৈত্র – নবদ্বীপের নিজস্ব উৎসব ক্যালেন্ডারে কোনও না কোনও উৎসব লেগেই আছে।

Advertisement

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৫ ০১:১৩
Share:

নবদ্বীপে পথ পরিক্রমায় ভক্তেরা। —ফাইল চিত্র।

তেরো পার্বণের শহর নবদ্বীপ। পার্বণ নিয়েই বাঁচে হাজার বছরের প্রাচীন এই জনপদ। এই শহরের ভাল-মন্দের সঙ্গে উৎসবের সম্পর্ক নিবিড় এবং গভীর। বৈশাখ থেকে চৈত্র – নবদ্বীপের নিজস্ব উৎসব ক্যালেন্ডারে কোনও না কোনও উৎসব লেগেই আছে। শিল্প-কারখানাহীন এ শহরের অর্থনীতি ভীষণ ভাবেই উৎসব এবং তার সঙ্গে সম্পর্কিত পর্যটনের উপর নির্ভরশীল। সেই উৎসব যাতে পঞ্জিকা নির্ধারিত তিথি-নক্ষত্রে আটকে না থেকে বারো মাসই শহরের অর্থনীতির পুষ্টিসাধন করে সেই ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজ।

Advertisement

এমনিতে উৎসবের টানে এ শহরে বারো মাস দেশি-বিদেশি পর্যটকের ভিড় লেগেই থাকে। শহরের পথে পথে ভক্ত ও পর্যটকদের ছোট বড় নানা দল। গ্রীষ্মের দুপুর, কুয়াশাছন্ন শীতের ভোর কিংবা রিমঝিম বৃষ্টির সন্ধ্যায় দলবেঁধে সেই সব মানুষেরা হেঁটে চলেন হাজার বছরের প্রাচীন জনপদের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। কারও যাত্রা উত্তর থেকে দক্ষিণে তো কেউ চলেছেন পশ্চিম থেকে পূর্বে। যাত্রাপথে ভক্তেরা একসঙ্গে গায় আনন্দগান। মৃদঙ্গের তালে তালে পা মিলিয়ে একসঙ্গে পথ হাঁটে আমেরিকা, আরামবাগ। বছরভর অসংখ্য মানুষ এ ভাবেই ঘুরে বেড়ায় চৈতন্যস্মৃতি বিজড়িত বৃহত্তর নবদ্বীপে। এই পথচলার পোশাকি নাম ‘নবদ্বীপ মণ্ডল পরিক্রমা’।

শ্রীচৈতন্যদেবের নবদ্বীপে থাকাকালীন সময়ের স্মৃতি বিজড়িত স্থানে সংকীর্তন সহযোগে পদব্রজে একবার পৌঁছনোই বৈষ্ণব ভক্তদের কাছে নবদ্বীপ মহামণ্ডল পরিক্রমা। প্রচলিত প্রথা হল সাত দিন, পাঁচ দিন বা তিন দিন, নিতান্ত অক্ষম হলে একটা দিন পায়ে পায়ে ছুঁয়ে যাওয়া চৈতন্যধামের ভগ্ন দেউল, নদীর পাড়, প্রান্তর, গাঁ-গঞ্জ। এই নবদ্বীপ মণ্ডল পরিক্রমা করতেই পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন ভক্তেরা।

Advertisement

নবদ্বীপ মণ্ডল পরিক্রমা মূলত দোল, রাস বা নিয়মসেবার মাসে হয়। নির্দিষ্ট সময়ে গঙ্গার দু’পাড়ের ছোট বড় সব মঠ-মন্দির কর্তৃপক্ষ তাঁদের মতো করে পৃথক ভাবে আয়োজন করেন পরিক্রমার। তবে দোলের সময়ে পরিক্রমায় বিপুল জনসমাগম অন্য সব কিছুকে ছাপিয়ে যায়। বলা বাহুল্য, তার প্রভাব পড়ে নবদ্বীপের স্থানীয় অর্থনীতিতেও। কারণ বিদেশিরা যখন থেকে নবদ্বীপে আসা শুরু করেছেন তখন থেকেই দোলের চরিত্রে আমূল বদল ঘটেছে। প্রথমে শুধু মায়াপুরেই সীমাবদ্ধ থাকলেও পরে নবদ্বীপের বিভিন্ন স্থানে বিদেশিরা আলাদা মঠ করেছেন। সেই সঙ্গে বেড়েছে স্থানীয় মঠের সংখ্যাও। প্রায় একমাস ধরে নবদ্বীপে লক্ষাধিক অতিরিক্ত মানুষ পর্যটক হিসাবে থাকছেন। সব কিছু স্থানীয় বাজার থেকে কিনে ব্যবহার করছেন। সব মিলিয়ে নবদ্বীপের দোল এখন শহরের বাণিজ্যের প্রধান ধারা। যা থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে উপকৃত হন শহরের রিকশা চালক থেকে বড় ব্যবসায়ী প্রত্যেকেই। সেই অর্থে নবদ্বীপের মূল বাণিজ্য মরসুম এখন দোল।

এই পরিক্রমা যাতে বারো মাস ধরেই চলে সেই লক্ষ্যে কাজ শুরু করছে নবদ্বীপের মঠ-মন্দিরের প্রধানদের সংগঠন, নবদ্বীপ গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজ। ঠিক কী করতে চাইছেন তাঁরা? সংগঠনের সম্পাদক অদ্বৈত দাস মহারাজ বলেন, “আমরা এমন একটি পরিকল্পনা নিয়েছি যাতে পর্যটকেরা সারা বছর নবদ্বীপে আসবেন এবং পরিক্রমায় যোগ দেবেন তাঁদের নিজের মতো করে।’’ তিনি জানান, শহর নবদ্বীপের প্রধান অর্থনৈতিক ভিত্তি এখন পর্যটন। তাঁত, কাঁসাপিতল শিল্প এই শহরের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকলেও অর্থনীতির সঙ্গে তার যোগ ক্রমশ ক্ষীণ হচ্ছে। কিন্তু মহাপ্রভুর কৃপায় সারা বিশ্বের মানুষ আজ নবদ্বীপের নাম জানে এবং তাঁর জন্মভূমি নবদ্বীপে একটি বার পা রাখার জন্য সারা পৃথিবীর বৈষ্ণব ভক্তেরা ব্যাকুল। তাই সারা বছর যদি পরিক্রমার ব্যবস্থা থাকে তাহলে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কৃপায় নবদ্বীপের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে।

অদ্বৈত দাস মহারাজ বলছেন, ‘‘আধুনিক পৃথিবী যেখানে পর্যটনকে অর্থনীতির উপাদান হিসেবে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে তখন চৈতন্যধাম নবদ্বীপঅ বা কেন সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকবে!’’ বারো মাস পরিক্রমার পরিকল্পনা রূপায়ণে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের সঙ্গে আছে নবদ্বীপ সনাতন সন্ত সমাজ এবং শ্রী চৈতন্য ভাবনামৃত সেবাশ্রমের মতো সংগঠন।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে নবদ্বীপ গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের সহ সভাপতি কিশোর কৃষ্ণ গোস্বামী জানান, দোল বা অনান্য উৎসবের সময়ে যে নবদ্বীপ মণ্ডল পরিক্রমার প্রথা চালু আছে সেখানে দীর্ঘ পথ পরিক্রমা করতে হয়। চৈতন্য জন্মস্থান প্রাচীন মায়াপুর থেকে শুরু করে বিদ্যানগর, জাহান্নগর, বেলপুকুর, হরিহরক্ষেত্রের মতো নবদ্বীপ এবং লাগোয়া বর্ধমানের চৈতন্যস্মৃতি বিজড়িত স্থানে দোলের পনেরো দিন আগে থেকে শুরু হয়ে যায় এই পরিক্রমা। ওই দীর্ঘপথ অনেকের পক্ষেই পাড়ি দেওয়া সম্ভব হয় না। বৃন্দাবনে যেমন ৮৪ ক্রোশের পাশাপাশি পঞ্চক্রোশ পরিক্রমার ব্যবস্থা আছে, তেমনি নবদ্বীপেও মহাপ্রভু মন্দিরকে কেন্দ্র করে একটি পঞ্চক্রোশী পরিক্রমা বৈষ্ণব ভক্তদের মধ্যে প্রচলিত আছে। কিন্তু সেই পরিক্রমা নবদ্বীপে কোনও নির্দিষ্ট পথ মেনে হয় না।

তিনি বলেন, “নবদ্বীপ গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজ সেই কারণে একটি পঞ্চক্রোশ পরিক্রমা মার্গ চিহ্নিত করেছে। যাতে বছরভর ভক্তরা সেই পথে পরিক্রমা করতে পারবেন। কোনও মঠ-মন্দিরের ব্যবস্থাপনার উপর নির্ভরশীল হতে হবে না। নবদ্বীপ পুরসভা-সহ স্থানীয় প্রশাসনের বিভিন্ন দফতরে এই বিষয়ে জানানো হয়েছে। পরিক্রমা মার্গ জুড়ে থাকছে পথ নির্দেশক চিহ্ন। ওই নির্দিষ্ট মার্গ ধরে বছরভর ধারাবাহিক পরিক্রমা চৈতন্যচর্চার পাশাপাশি নবদ্বীপের বাণিজ্যকেও প্রসারিত করবে।”

এ প্রসঙ্গে নবদ্বীপ সনাতন সন্ত সমাজের সম্পাদক নিত্যযুক্তানন্দ অবধূত বলেন, “হাজার বছরের প্রাচীন শহর নবদ্বীপের সঙ্গে আধ্যাত্ম ভাবনার সম্পর্ক নিবিড়। বৌদ্ধ, শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব সব মতের মেলবন্ধন ঘটেছে নবদ্বীপে। সুতরাং এখানে মানুষ আসবেন, ভক্তিবাদের প্রবাহে ভাসবেন এটাই স্বাভাবিক। ভক্তদের নিত্য যাতায়াতে স্থানীয় মানুষের জীবন জীবিকা সমৃদ্ধ হোক, এটাই আমরা চাই। নির্দিষ্ট পথে নিয়মিত পরিক্রমায় সুনিশ্চিত ভাবেই নবদ্বীপের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে।”

বছরভর পরিক্রমার উদ্যোগে খুশি স্থানীয় ব্যবসায়ী মহল। নবদ্বীপ ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক নিরঞ্জন দাস বলেন, “খুবই ভাল উদ্যোগ। সারা বছর ধরে মানুষ আসবেন। নির্দিষ্ট পথে পরিক্রমা করে এই শহরেই থাকবেন। সব মিলিয়ে বারো মাসই বাণিজ্যের একটা চক্রাকার প্রবাহ থাকবে। যার ফলে উপকৃত হবেন নবদ্বীপের সব শ্রেণির ব্যবসায়ী।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement