গত বছর নোটবন্দিতে এক বার তাঁরা বড়সড় ধাক্কা খেয়েছেন। সেই ক্ষতি সামলে ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই ফের শাঁখার কারবারে বাদ সাধল উত্তরবঙ্গ ও অসমের বন্যা।
সামনে পুজো, দিন কয়েক বাদে ইদও। সারা বছর বিক্রিবাটা হলেও পুজোর সময়ে শাঁখার চাহিদা তুঙ্গে ওঠে। দিনরাত কাজ করে উৎসবের আগে বাড়তি রোজগার করেন হিন্দু ও মুসলিম কারিগরেরা। ব্যবসায়ীদের তো বটেই, তাঁদেরও মাথায় হাত।
নদিয়ার করিমপুর বা মুর্শিদাবাদের ডোমকল— একটা বড় এলাকা জুড়ে কয়েক হাজার মানুষ শাঁখা শিল্পে যুক্ত। জলপাইগুড়ি, দুই দিনাজপুর, কোচবিহার, মালদহ ছাড়াও ত্রিপুরা ও অসমে শাঁখা যায় এখান থেকেই। মালদহের মহদিপুর দিয়ে সীমান্ত পার করে তা যায় বাংলাদেশেও। বন্যায় পথঘাট ডুবে গিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় এখন কারবার লাটে।
করিমপুরের মুরুটিয়ায় শঙ্খনগর ও বালিয়াডাঙায় প্রায় তিনশো শাঁখা ব্যবসায়ী রয়েছেন। তাঁদের অন্যতম, শঙ্খনগরের সাধন পাল জানান, প্রায় আড়াই হাজার শিল্পী ও শ্রমিকের পরিবার নির্ভরশীল। নোটবন্দির পরে তাঁরা ফের সঙ্কটে পড়েছেন।
ডোমকলের জিতপুর ও বাজিতপুর গ্রাম এবং আশপাশের এলাকায় শাঁখা শিল্পের রমরমা। বাজিতপুর এলাকার লক্ষ্মীনাথপুরের ব্যবসায়ী প্রসেনজিৎ দেব বলেন, ‘‘এই এলাকার হাজারো মুসলিম শিল্পী শাঁখা শিল্পে যুক্ত। ঈদের আগে কী ভাবে তাঁদের টাকা দেব, সেটাই ভাবছি।’’ শিল্পী কাজিম শেখ বলেন, ‘‘ইদের সময়ে আমরা একটু বেশি টাকা মালিকদের থেকে চেয়ে নিই। পরে কাজ করে ধার শোধ করি। কিন্তু এ বার আগাম দূরে থাক, মজুরি পাওয়াই কঠিন।’’
ব্যবসায়ীদের হিসেবে, সারা বছরে যে পরিমাণ শাঁখা বিক্রি হয়, তার চেয়ে ত্রিশ শতাংশ বেশি হয় পুজোর মরশুমে। এ বার তা ধাক্কা খেয়েছে। শাঁখা শিল্পী তারকেশ্বর পাল বলেন, “কাঁচামাল শঙ্খ আসে চেন্নাই ও শ্রীলঙ্কা থেকে। এখানে তৈরি শাঁখার বেশির ভাগটা বিক্রি হয় উত্তরবঙ্গ ও ত্রিপুরা ও অসমে। পুজোর সময়ে চাহিদা বেশি থাকায় সব ব্যবসায়ীই প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ বেশি কাঁচামাল কিনে মজুত করেন। এ বারেও তা-ই করেছেন। কিন্তু বিক্রিই বন্ধ।’’
শাঁখা শ্রমিক বাবু স্বর্ণকার, সায়ন পাল বা মান্টু সিংহ রায় জানান, মাঠের কাজ ছেড়ে এলাকার অনেকে এখন শাঁখার কাজ করেন। প্রতি বছর পুজোর আগে বেশি কাজ করে সবাই বেশি রোজগার করে। এ বছরও কাজ বেশি হয়েছে। কিন্তু বিক্রির টাকা না এলে মালিকেরা মজুরি দেবেন কী করে?” জিতপুরের ব্যবসায়ী অপূর্ব পাল বলেন, ‘‘আমরা ওঁদের সামনে দাঁড়াতে পারছি না। প্রায় ১০০ শিল্পী আছেন আমার কারখানায়। তাঁদের মজুরি কী ভাবে মেটাব, সেটা এখনও ভেবে উঠতে পারিনি।’’
যাঁরা উত্তরে শাঁখা ফেরি করতে যান, তাঁরাও বসে গিয়েছেন। আবার শাঁখা বিক্রির শেষে ও দিকেই আটকে আছেন কেউ, ঘরে ফিরতে পারেননি। হকার বাবর আলি বলেন, ‘‘প্রতি বার এই সময়ে একটু বেশি বিক্রিবাটা হয়, তা দিয়েই ইদ মানাই। এ বারের ইদ আর খুশির হবে না।’’