কিরিং কিরিং— ক্লাবের সামনে বেজে উঠল সাইকেলের বেল।
শুনেই পড়ি কি মরি দরজার দিকে ছুটে গেলেন দুই যুবক। মুখে এক গাল হাসি— যাক বাবা, পাওয়া গেল তা হলে! না হলে ঘুরে মরতে হত! না হয় একটু বেশিই নিল।”
সুপ্রিম কোর্টের ধাক্কায় জেলার প্রায় অর্ধেক মদের দোকান বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে বোতল পাওয়ার অন্য নানা পথ খুলেছে। শুক্রবার গুজবের জেরে হঠাৎ দোকান-পানশালা খুলে গেলেও তার আয়ু ক’দিন তা নিয়ে সকলেরই ঘোর সন্দেহ আছে। ফলে, চোরাপথই হয়ে উঠছে রাজপথ।
এমনিতেই কৃষ্ণনগর শহরে মদের ‘হোম ডেলিভারি’ শুরু হয়েছে অনেক আগেই। গত ১ এপ্রিল থেকে তাদের ব্যস্ততা বেড়ে গিয়েছে অনেকটাই। কারণ দোকান বন্ধ থাকায় সমস্যায় পড়ে গিয়েছেন ভদ্রলোকেরা। কারণ, বেশি টাকা দিয়ে হোটেল-গুমটি-ধাবা থেকে লুকিয়ে মদ কিনতে হচ্ছে বেশি টাকা দিয়ে। তার চেয়ে ঢের সহজ ফোন করে মদ দিয়ে যেতে বলা। দাম একটু বেশি পড়লেও ক্ষতি নেই। এই সুযোগে দর আরও দশ টাকা করে বাড়িয়ে দিয়েছে ডেলিভারি বয়েরা।
বহরমপুরেও মদের কালোবাজারে বিক্রেতাদের দেমাক তুঙ্গে। আগে ফোনে ‘অর্ডার’ পেলে বাড়ি বয়ে যাঁরা বোতল দিয়ে যেতেন, এখন ফোন পেয়েই তাঁরা বলে দিচ্ছেন, ‘‘না দাদা! বাড়ি যেতে পারব না। খদ্দেরের চাপ বেশি। বাসস্ট্যান্ডে চলে আসুন।’’ যাঁরা কোনও দিন মদের কারবার করেননি, এমন কিছু লোকজনও চড়া লাভের আশায় নিজেদের বাড়ি থেকে গোপনে মদ বিক্রি করেছেন পরিচিত লোকজনের কাছে।
সন্ধে হলেই কৃষ্ণনাথ কলেজের কাছে বাজারের ঝোলা হাতে চক্কর কাটতেন এক প্রৌঢ়া। সেই ঝোলায় দিশি-বিলিতি দু’ই থাকত। নদীপাড়ে সন্ধ্যার হাওয়া খেতে আসা লোকেরা তাঁর খদ্দের। এখন আর তিনি পথে চক্কর কাটছেন না। গাঁধী কলোনির একটি ঘরে বসে মদ বিক্রি করছেন। বাতাস শুঁকে খদ্দের সুড়সুড় করে হাজির হয়ে যাচ্ছে সেখানেও। প্রৌঢ়া বলেন, ‘‘বহরমপুর শহরে মোটে ৩টে দোকান খোলা। তাই আমাদের কাছে ভিড় খুব। আগের মতো আর রাস্তায় হকারি করতে হচ্ছে না।’’ বহরমপুর বাসস্ট্যান্ডে মোটরবাইক নিয়ে ঘুরে বছর তিরিশ ধরে ভ্রাম্যমাণ মদের দোকান চালাচ্ছেন কচিদা। তিনিও এখন ঝুপড়িতে ঢুকেছেন।
বহু জায়গাতেই অবশ্য প্রথম দিকে দরটা একটু পড়েছিল। অনিশ্চয়তার কারণে স্টক খালি করতে অনেক দোকান কম দামে মাল দিয়ে দিচ্ছিল। পরে কার যেন আশ্বাস পেয়ে সামলে গিয়েছে। দাম কমার বদলে বাড়তে শুরু করেছে। ঝাঁপ ফেলা দোকানের পিছনের দরজা থেকে চড়া দামেই বিক্রি হয়েছে বোতল। যেখানে সেটা হয়নি, সেখানে ছোট হোটেল আর ধাবা থেকে ৩০-৪০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হয়েছে মদ। করিমপুর হোক বা কৃষ্ণনগর, হরিণঘাটা, বেথুয়াডহরি— স্টেশন বা বাসস্ট্যান্ডের কাছে প্রায় প্রকাশ্যে মদ বিক্রি হয়েছে। চাপড়ার দইয়েরবাজার বাসস্ট্যান্ডের ছোট হোটেলে ৬৫ টাকার বাংলা মদের বোতল বিক্রি হয়েছে ১২৫ টাকায়।
গোরাবাজার এলাকার বিভাস দাস রোজ কেনেন রামের একটি ‘নিপ’। তাঁর আক্ষেপ, ‘‘৮০ টাকার ‘নিপ’ ব্ল্যাকে কিনতাম ১১০ টাকায়, এখন পড়ছে ১৭০ টাকা।’’ কালোবাজারি করবেন, এমনটা কখনও ভাবেননি লালগোলার প্রদীপ হালদার। তিনি বলেন, ‘‘ডবলেরও বেশি লাভ দাদা। মদের দোকান থেকে গোপনে বোতল কিনে নিয়ে বাড়ি থেকেই পরিচিতদের মধ্যে বিক্রি করছি।’’
চালু দোকান বন্ধ হয়ে যেন অ়জস্র অদৃশ্য দোকান খুলে গিয়েছে। তার বেশি কিছু নয়।