ঝাঁপ বন্ধ ব্যাঙ্কে, দিনভর টিমটিম করল ডাকঘর

মাসের শেষ শনিবার। ব্যাঙ্কে তালা। পুরনো নোটের গতি করতে ভরসা সবে ধর নীলমণি পোস্ট অফিস। কিন্তু তাতেই বা কী? নতুন নোটের উৎস তো সেই ব্যাঙ্ক।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০১৬ ০০:৫০
Share:

মাসের শেষ শনিবার। ব্যাঙ্কে তালা। পুরনো নোটের গতি করতে ভরসা সবে ধর নীলমণি পোস্ট অফিস। কিন্তু তাতেই বা কী? নতুন নোটের উৎস তো সেই ব্যাঙ্ক।

Advertisement

ফলে দিনের শেষে খালি হাতেই ফিরতে হয়েছে অনেককে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভাগ্যবান গুটিকয় লোক (এবং অবশ্যই প্রয়োজনের গুরুত্ব বুঝে) সর্বোচ্চ হাজার দশেক টাকা পেয়েছেন। ব্যস, ওই পর্যন্তই।

কৃষ্ণনগরের হেড পোস্ট অফিসই যেমন। ব্যাঙ্ক বন্ধ। তাই আর পাঁচটা দিনের তুলনায় পোস্ট অফিসের ভিড়টা ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু তারাও যে টাকা পায় ব্যাঙ্ক থেকেই। ফলে দাবি-দাওয়া থাকলেই বা কী, টাকাটা তারা দেবে কোথা থেকে? পুরনো যেটুকু মজুত, ভরসা তাই। কৃষ্ণনগর হেড পোস্ট অফিসে দু’টো কাউন্টার থেকে মাত্র দুই-দুই চার লক্ষ টাকা দেওয়া হয়েছে শনিবার। সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। টাকা ফুরিয়ে যাওয়ার পরে বন্ধ করে দেওয়া হয় কাউন্টার। ফলে খালি হাতে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন বহু মানুষ।

Advertisement

শুক্রবার অবশ্য ১০ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়েছিল। যদিও সেটা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম বলে দাবি পোস্ট মাস্টার প্রমথ রায়ের। তিনি বলেন, “চেস্ট ব্যাঙ্কের (রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে যে ব্যাঙ্কের মাধ্যমে জেলা পোস্ট অফিসে টাকা আসে) কাছ থেকে যা টাকা পাচ্ছি, সেটা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারে কম। তার মধ্যে আজ আবার শনিবার। ফলে ব্যাঙ্ক থেকে কোনও টাকাই পাইনি। নিজেদের কাছে যা ছিল, তাই দিয়েই চালাতে হয়েছে।”

তার পর জমানো টাকারও তো ভাগ বাটোয়ারা আছে। নিজেদের ছাড়াও টাকা দিতে হয়েছে ১২টি সাব পোস্ট অফিসকে। কেউ পেয়েছে মাত্র এক লক্ষ তো কেউ পঞ্চাশ হাজার। যেমন ঘূর্ণি সাব পোস্ট অফিস পেয়েছে এক লক্ষ টাকা। তাদের অধীনে আবার ১৩টি শাখা অফিস। এ দিন সেই শাখা অফিসকে তারা এক টাকাও দিতে পারেননি। ফলেই ওই সব শাখা পোস্ট অফিস থেকে মানুষ ফিরে গিয়েছে কোনও টাকা না পেয়েই।

ঘূর্ণি সাব পোস্ট অফিস মাত্র ৩৫ জনকে টাকা দিতে পেরেছে শনিবার। তা-ও সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা। পোস্ট মাস্টার গোবিন্দ মোদক বলেন, “শুধু আজকেই আমাদের দরকার ছিল কমপক্ষে সাড়ে সাত লক্ষ টাকা। অথচ দেওয়া হয়েছে মাত্র এক লক্ষ। এ ভাবে চালানো যায়? বলুন।” সেখানেও খালি হাতে ফিরে গিয়েছেন অনেকে। এদেরই এক জন ঘূ্র্ণির বাসিন্দা দীপক প্রামাণিক। এমআইএসের টাকা তুলতে দু’দিন লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু টাকা আর মিলল কই! এ দিনও লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই এক সময় জানিয়ে দেওয়া হল, ‘‘আজকের মতো শেষ।’’ ঝাঁপ পড়ে গেল কাউন্টারের। ‘‘আর কী, আবার এক দিন লাইন দিতে হবে। কবে যে নিজেরই হকের টাকার মুখ দেখব...?’’ আক্ষেপ ঝরে গড়ল দীপকের গলা থেকে। বললেন, “সংসার চালাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি।”

বহরমপুর শহরে গোরাবাজার পোস্ট অফিস থেকে দেওয়া হয়েছে আড়াই হাজার করে। বহরমপুরের হেড পোস্ট মাস্টার বিবেকান্দ মণ্ডল বলেন, ‘‘টাকার জোগান না থাকায় ২০ টাকার নোটে দু’হাজার টাকা ও ১০ টাকার নোট ও কয়েনে এক হাজার টাকা মিলিয়ে মোট ৩ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে।’’ টাকা তোলার জন্য ওই পোস্ট অফিসের লাইনে দাঁড়ানো শ্যামল দাশ বলেন, ‘‘১০ টাকার কয়েন গুজবের জন্য অচল হয়ে পড়েছে। বাধ্য হয়েই কুড়ি টাকার নোটে দু’হাজার নিয়েছি।’’ শনিবার মুর্শিদাবাদ সাব পোস্ট অফিস থেকে ৩ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। সাব পোস্ট মাস্টার কৌশিক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘এখান থেকে ৬টি সাব পোস্ট অফিস এবং ৭টি ব্রাঞ্চ পোস্ট অফিসে টাকা পাঠানো হয়েছে।’’ ওই সাব পোস্ট অফিসের অধীনে থাকা বেশ কয়েকটি ব্রাঞ্চ পোস্ট অফিস টাকা পায়নি। বলা বাহুল্য, যারা পেয়েছে তাদের টাকার পরিমাণও প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য।

লালগোলা সাব পোস্ট মাস্টার অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘টাকা কম থাকায় এক জনকে দু’হাজার টাকার বেশি দেওয়া যায়নি। ১৩টি ব্রাঞ্চ পোস্ট অফিসের মধ্যে ৫টিকে কিছু টাকা দেওয়া হয়েছে। বাকি ৮টিকে টাকা দেওয়া সম্ভব হয়নি।’’

রানাঘাট পোস্ট অফিসে এখনও পাঁচশোর নোট আসেনি। সামান্য কিছু একশোর নোট। দুই, পাঁচ, দশ টাকার কয়েন, যে যা পারছে দিচ্ছে।

রানাঘাট মুখ্য ডাকঘরে সর্বোচ্চ ২৪ হাজার টাকা দেওয়া হলেও, অধিকাংশ উপ-ডাকঘরে কোথাও এত টাকা দেওয়া হয়নি। কোথাও দুই তো কোথাও তিন-চার হাজার দিয়েই ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সব চেয়ে করুণ অবস্থা কুপার্স ক্যাম্প উপডাকঘরে। স্থানীয় বাসিন্দা বিমল বিশ্বাস বলেন, “এক দিন বই জমা দিয়ে যেতে হচ্ছে। পরের দিন গিয়ে টাকা তুলছি।”

এ দিন বেলা দেড়টা নাগাদ পোস্টমাস্টার ফিরলেন রানাঘাটের মুখ্য ডাকঘর থেকে। ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে তিনি জানালেন, “দু’মাস ধরে লিঙ্কের সমস্যা রয়েছে। তাই সঙ্গে সঙ্গে টাকা দেওয়া যাচ্ছে না। আমরা বই জমা নিচ্ছি। সেই বই রানাঘাট মুখ্য ডাকঘরে জমা দিচ্ছি। পরের দিন গ্রাহকদের টাকা দেওয়া হচ্ছে। শনিবার যাঁরা বই জমা দিয়ে গেলেন, তাঁরা অবশ্য সোমবার টাকা পাবেন।”

নাসড়া উপডাকঘরে কোনও লোক দেখা গেল না। পোস্টমাস্টার বললেন, “লোক আসবে কেন বলুন? ঠিক মতো টাকা দিতে পারছি না যে। লিঙ্কের সমস্যা নিয়ে ভুগছি। তার পরে পাঁচ, দশ, দু’টাকার কয়েন পাঠানো হয়েছে। অনেকেই তা নিতে চাইছেন না। দশ টাকার নোটগুলোর খুব খারাপ অবস্থা। এ সব নিয়ে গ্রাহকদের সঙ্গে ঝামেলা লাগছে।”

আজ রবিবারও ব্যাঙ্ক বন্ধ থাকবে। ফলে আগামীকাল সোমবার অধিকাংশ গ্রামীণ পোস্ট অফিস থেকে টাকা না পাওয়ার আশঙ্কা প্রবল। কারণ আগের দিন এসবিআই থেকে টাকা তুলে পরের দিন গ্রামীণ এলাকার পোস্ট অফিসকে টাকা দেওয়া হয়। ফলে শিয়রে সমন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement