মোমের আলোয় ভাষা দিবস পালন, রঘুনাথগঞ্জে।
শুরুটা বাংলা থেকে। কিন্তু দিনটা তো আর বাংলায় আটকে নেই।
দিনটা এখন সকলের। পৃথিবীর যে যেখানে যে ভাষায় কথা বলে, তার সেই নিজের ভাষার উদ্যাপন।
গঙ্গার এলোকেশ বাঁধা ব্যারাজের কল্যাণে ফরাক্কা দেশের নানা প্রান্তের মানুষের মিলনমেলা। কেউ এসেছেন অন্ধ্রের শ্রীকাকুলাম থেকে, তো কেউ অসমের কোকড়াঝাড়। কারও পঞ্জাবে কপূরথলায় ভিটে, তো কারও ঘুমে।
তাঁরাই ফরাক্কা ব্যারাজ রিক্রিয়েশন মাঠে চেনালেন দিনটাকে।
শিক্ষকতার চাকরি নিয়ে ১৪ বছর আগে ফরাক্কায় এসেছিলেন বছর ছেচল্লিশের প্রশান্ত মার্ডি। বাড়িতে স্ত্রী আর দুই মেয়ের সঙ্গে বাংলায় কথা বলেন, মায়ের সঙ্গে বলেন সাঁওতালি। মাতৃভাষা মঞ্চে গিটার হাতে গাইলেন সাঁওতালি গান। ব্যারাজের সহকারী বাস্তুকার অংশুময় লোহারি অসমের কোকড়াঝাড়ের লোক। দিব্যি বাংলা বলেন। বাড়িতে অসমিয়া চলে। তিনি গাইলেন অসমের এক প্রবাদপ্রতিম কবির লেখা গান।
কপূরথলা থেকে ব্যারাজে চাকরি নিয়ে এসেছিলেন সতপাল সিংহ। এই মার্চেই অবসর। তাঁর ছেলে ভূপিন্দরের জন্ম-কর্ম এখানেই। বৌমা অবিনাশ কৌর মঞ্চে উঠে ধরলেন পঞ্জাবি গান। সঙ্গে গলা মেলালেন ভূপিন্দরও। শ্রীকাকুলাম থেকে ব্যারাজে চাকরি নিয়ে এসেছিলেন এন লক্ষ্মীর বাবা। তিনি মারা গিয়েছেন। লক্ষ্মী এখানেই স্কুলে পড়ান। তেলুগু গানের সঙ্গে ভারতনাট্যম নাচল তাঁর ক্লাস সেভেনে পড়া মেয়ে এন কেশৌরি। লক্ষ্মী বলেন, “বাড়িতে কিন্তু আমরা সকলেই কথা বলি তেলুগুতে।”
দিল্লির নয়ন রাজ ব্যবসা সূত্রে ফরাক্কায় দীর্ঘদিন। আতাউল্লা খানের ভক্ত তিনি, গাইলেন তাঁরই গাওয়া একটি গজল। ধুলিয়ানের আরিফ আনসারি আবার কর্মসূত্রে থাকেন উত্তরপ্রদেশে। ভাষামঞ্চে গাইলেন উর্দু গজল, শোনালেন শায়েরি। বললেন, “উর্দু বলি ঠিকই, আবুল-বরকতের বাংলাই কিন্তু আমার মাতৃভাষা।”
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষার মর্যাদার লড়াইয়ে শহিদ হন সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারেরা। বরকতের জন্ম মুর্শিদাবাদেরই সালার থানার বাবলা গ্রামে। প্রতি বছরই বাবলা গ্রামে দিনটা উদ্যাপন করেন আবুল অরকত স্মৃতি সঙ্ঘ। এ বারও করেছে। বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে পড়তেন বরকত। সেখানেও শহিদ বেদিতে মাল্যদান হয়েছে।
বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা ডোমকল, করিমপুর, তেহট্টে ফি বারই বাতাসে ভাসে আবেগ। ডোমকলে একুশের গান গেয়ে পথ হাঁটলেন ছাত্রছাত্রীরা। তেহট্টের কাটাতাঁর ঘেঁষা পাথরঘাটায় চাচা ফকিরের মাঠ মুখর হল গানে-গানে। সেখান থেকে কিলোমিটার খানেকের মধ্যেই সেই গ্রাম যেখানে জন্মেছিলেম মুজিবর রহমান, এখন তা বাংলাদেশের মুজিবনগর।
দার্জিংলিঙের ঘুম থেকে নেমে ফরাক্কার বিডিও হয়েছেন কেশাং ধেনডুপ ভুটিয়া। বাংলা বোঝেন, কিন্তু বলতে গেলে বাধে। মাতৃভাষা মঞ্চে গাইলেন নেপালি গান।
আর, এই আন্তর্জাতিকতার পরতে মিশে রইল বাংলা। বসন্তের দমকা বাতাসে কাঁটাতার পেরিয়ে যেন ভেসে এল আল মাহমুদের একুশের কবিতা: প্রভাতফেরী, প্রভাতফেরী/ আমায় নেবে সঙ্গে,/ বাংলা আমার বচন, আমি/ জন্মেছি এই বঙ্গে।