চলছে ঝাঁপান গানের অনুশীলন। —নিজস্ব চিত্র
ঝাঁপান গানেও উঠে আসছে নাগরিক জীবন। সৌজন্যে নোট বাতিল।
বাড়ির দাওয়ায় বসে বাঁধা নতুন গানটি গুনগুন করছিলেন ঝাঁপানের এক শিল্পী।
মাঝপথে তাঁকে থামিয়ে দেন কৃষ্ণনগরের রামপ্রসাদ বিশ্বাস, ‘‘না হে, হচ্ছে না। এ ভাবে ধরো— ‘কয়েন-টাকা ছিল যত নাতি নাতনির কাছে/ ভাঁড় ভাঙিয়া এনে তারা দিল দাদুর হাতে।’ কই, আর একবার শুরু কর।”
কৃষ্ণনগর শহর ঘেঁষা সন্ধ্যামাঠ পাড়ায় বাড়ি রামপ্রসাদের। সেই ছোটবেলায় ঝাঁপানের তালিম নিয়েছিলেন বাবার কাছে। এখন ঝাঁপানের পাশাপাশি তাঁকে সরকারি অনুষ্ঠানেও গান গাইতে হয়। কখনও সবুজসাথী, কখনও কন্যাশ্রী নিয়েও তিনি গান বাঁধেন। তাঁর গানে উঠে এসেছে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম। এ বারেও তাই তিনি স্থির থাকতে পারলেন না। গান বাঁধলেন ‘অর্থ-হীন’ জীবনের। সুর দিলেন। ডাক দিলেন সহ শিল্পীদের। এখন তাঁদের নিয়ে সন্ধ্যা থেকেই চলছে মহড়া।
রামপ্রসাদ জানান, প্রত্যন্ত গ্রাম-বাংলায় তাঁকে গান গাইতে যেতে হয়। ৮ নভেম্বরের পরে নোট বাতিলের ধাক্কায় মানুষের স্বাভাবিক জীবন জোর হোঁচট খেয়েছে। ব্যাঙ্কে টাকা থেকেও লোকে তুলতে পারছে না। বন্ধ এটিএম। শিকেয় উঠেছে চাষআবাদ, ব্যবসা-বাণিজ্য। এ সব দেখে তিনি আর স্থির থাকতে পারেননি। তাই ঝাঁপানেও উঠে এল টাকার কথা।
তাঁর গানের পরতে পরতে উঠে এসেছে নোট বাতিলের ফলে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন দুঃখ, যন্ত্রণার কথা। কখনও গাইছেন, “দু’হাজার টাকার নোট সরকার বাহির করে/ সেই নোট ভাঙাব কোথায় ঘুরি দ্বারে দ্বারে।” কখনও আবার, ‘‘এটিএমে টাকা নাই ব্যাঙ্কে গেলেও তাই/ শতলোকের লাইন দেখি, করি কী উপায়।” ধুয়ো ধরছেন সহ-শিল্পীরা। তারপর গান শেষ হলে সবাই মিলে বলছেন,
‘‘সাধু, সাধু।’’
রামপ্রসাদ বলছেন, ‘‘গানের প্রথম গুরু বাবা। পরে গান শিখি হিজুলির ঝাঁপান শিল্পী মুরারি বিশ্বাসের কাছে।’’ এখন তিনি নিজের দল নিয়ে নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান, দুই ২৪ পরগনার বিভিন্ন গ্রামে যান গান শোনাতে। বায়নাও আসে। তবে রামপ্রসাদের আক্ষেপ, ‘‘সেই নিখাদ ঝাঁপান গান ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে, জানেন। এখন লোকজন ঝাঁপানের আসরেও অন্য গান শুনতে চান। আমরাও নিরুপায় হয়ে শোনাই।’’ এই এখন যেমন। টাকাটাই সবথেকে জ্বলন্ত সমস্যা। এক নোটের ধাক্কায় গোট দেশ কেঁপে গিয়েছে। তাই টাকা নিয়েও রামপ্রসাদ গান বেঁধে ফেলেছেন।
তিনি জানান, শিল্পীরাও তো সমাজের বাইরের নয়। সমাজের ভাল মন্দ তাঁদেরও নাড়া দেয়। তাই গানেও উঠে আসে সে সব কথা।
সব শুনে সহশিল্পী যাদব হালদার বলছেন, “এ সমস্যা তো আমাদের নিজেদেরও। নিজেদের দিয়েই তো আমরা বুঝতে পারছি অন্যদের যন্ত্রণার কথা। ইতিমধ্যে বেশ কয়েক জায়গায় নতুন এই গান শুনিয়েছি। লোকজনের বেশ পছন্দও হয়েছে।”