কৃষ্ণনগর সংশোধনাগারে অনুষ্ঠিত ‘রক্তকরবী’ নাটকের একটি মুহূর্ত। নিজস্ব চিত্র
পিঠে আছড়ে পড়ছে সর্দারের চাবুক। আর সামনে বসা মানুষগুলোর মুখ কুঁকড়ে উঠছে যন্ত্রণায়।
ওরা সংশোধনাগরের আবাসিক। কেউ খুনের অভিযোগে জেল খাটছে। কারও মাথায় ঝুলছে আরও কোনও নৃশংস অপরাধের শাস্তি। তবু নাটকে চরিত্রগুলোর কষ্টে ওরাও কষ্ট পাচ্ছে। যা দেখে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অছি পরিষদের অন্যতম সদস্য স্বামী দিব্যানন্দ বলছেন, “একেই বলে আত্মশুদ্ধি। মনের ভিতর থেকে ‘কু’ টেনে বের করে আনা। নাটকের মাধ্যমে আমরা সবাইকে উত্তরণের পথে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি।”
কৃষ্ণনগর জেলা সংশোধনাগারে রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ মঞ্চস্থ করেন আবাসিকেরা। শুক্রবার সন্ধ্যায় এই আয়োজন ছিল রামকৃষ্ণ মিশনের। ‘কৃষ্ণনগর সিঞ্চন’-এর কর্ণধার সুশান্ত হালদারের নির্দেশনা। সংশোধনাগারে তেমন মহিলা অভিনেত্রী না পাওয়ায় তাঁদের সংস্থার দুই মহিলা সদস্য প্রীতিলতা নন্দী ও শুভ্রা রায় অভিনয় করেছেন। আগামী ২৩ মার্চ রবীন্দ্র ভবনে এই নাটকই মঞ্চস্থ করবেন আবাসিকেরা।
গত বছরই প্রথম তাঁরা মঞ্চস্থ করছিলেন বিবেকানন্দের জীবনাশ্রিত নাটক ‘মহাবৃত্তে’। কৃষ্ণনগর রবীন্দ্র ভবনের পাশাপাশি কলকাতাতেও তা মঞ্চস্থ করা হয়েছিল। এ বারও তাঁরা সেই পথেই হাঁটছেন জানিয়ে কারামন্ত্রী উজ্জ্বল বিশ্বাস বলেন, “এই নাটক আমরা অনেক-অনেক মানুষের কাছে পৌঁছে দেব।”
সংশোধনাগারের ভিতরে মাঠে অস্থায়ী মঞ্চের সামনে যেন উপচে পড়েছিল গোটা সংশোধনাগার। সামনে মাটিতে ত্রিপল বিছানো। তারই উপরে ছোট-ছোট শিশু কোলে মহিলা আবাসিকেরা। ডান দিকে একটু দূরে বসেছে খাবারের স্টল। চা- কফির পাশাপাশি বিক্রি হচ্ছে চাউমিন থেকে নানা ধরনের ভাজা। যাকে বলে উৎসবের মেজাজ।
নাটকে রাজার চরিত্রে অভিনয় করেছেন এমন এক জন যিনি খুনে অভিযুক্ত। সর্দারদের এক জন আবার করিমপুরে খুন ও ব্যাঙ্ক ডাকাতিতে অন্যতম অভিযুক্ত। গত আট মাস ১৬ জন আবাসিককে নিয়ে নাটকের মহড়া দিয়ে এসেছেন সুশান্ত হালদার। নাটক শেষে তাঁরা বলেন, “হতাশা আমাদের গ্রাস করে নিচ্ছিল। নাটকটা করার জন্য যে দিন থেকে মহলা শুরু করেছি সে দিন থেকেই মনে হয়েছে, বাঁচার জন্য অনেক কিছুই পড়ে আছে।”
নাটকের মধ্যে দিয়ে কাউন্সেলিং-এর কাজটা যে সফল ভাবে চলছে, তা বোঝা যায় যখন মঞ্চ থেকে নেমে গ্রিনরুমে দাঁড়িয়ে কেউ কেউ নিজের কাজের জন্য অনুশোচনা করেন। প্রীতিলতা বলেন, “প্রথম প্রথম একটা ভয় লাগত। অস্বস্তি হত। পরে দেখলাম, ওরা আমাদের আপন করে নিয়েছে। এখন একটা পরিবারের মনে হয়।”