প্রতীকী ছবি।
অবারিত স্বাধীনতার আস্বাদ কে না চায়!
দেশ নামক শব্দটির অন্তর্নিহিত নির্যাসের ধারার প্রতিটি বিন্দু থেকে গলে পড়ে দেশবাসীর তীব্র আবেগের উষ্ণ প্রস্রবণ। ফলে, দেশ এবং তার স্বাধীনতা উদ্যাপনের বিষয়টি দেশের প্রতিটি নাগরিকের কাছেই তাঁর আবেগমথিত-গর্বিত ইতিবৃত্তের এক অনাবিল সুখানুভূতি। যার প্রতিফলন দেখা যায় সমাজের প্রতিটি স্তরে। নাগরিক চেতনার উন্মুক্ত অলিন্দে। ইদানিং কালে আবালবৃদ্ধবনিতার মুঠোবন্দি সোশ্যাল মিডিয়ার আবেগের পাতা জুড়ে।
ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাসের প্রতিটি পাতায় পাতায় লেগে রয়েছে লক্ষ মানুষের আত্মোৎসর্গ, ত্যাগ ও বলিদানের উজ্জ্বল চিরহরিৎ নিশান। অথচ, দেশের স্বাধীনতার জন্য উৎসর্গীকৃত লক্ষ মহান প্রাণের গর্বিত বলিদানের পরেও আমরা পেয়েছি দ্বিজাতি সত্তার কণ্টকমালায় বিদ্ধ দ্বিখণ্ডিত দেশ এবং তার স্বাধীনতা। যদিও ভারতবাসী হিসাবে নিঃসন্দেহে আমাদের কাছে গর্বিত সুখানুভূতি এই যে, দ্বিখণ্ডিত দেশটার একটা অংশ একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্ত রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও ভারত নামক বৃহৎ অংশটি সদর্পে এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবেই।
তাই আমাদের ভারত রাষ্ট্রের নিজস্ব কোনও ধর্মীয় বর্ম নেই। বহুত্ববাদের এই ভারতভূমির বক্ষ জুড়ে বহুধর্মের সমন্বয়, বহু ভাষার সমন্বয়, বহুসংস্কৃতির সমন্বয়। বহুত্ববাদের পরম্পরায় গড়ে ওঠা আমাদের এই স্বাধীন ভারতের কোনও নির্দিষ্ট রং নেই। ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনার চিরহরিৎ পাতাগুলো আপামর ভারতবাসীকে গর্বিত করে— “আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র রূপে গড়িয়া তুলিতে, এবং উহার সকল নাগরিক যাহাতে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তার, অভিব্যাক্তির, বিশ্বাসের, ধর্মের ও উপাসনার স্বাধীনতা; প্রতিষ্ঠা ও সুযোগের সমতা নিশ্চিত ভাবে লাভ করেন; এবং তাঁহাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-মর্যাদা ও ঐক্য ও সংহতির আশ্বাসক ভাতৃভাব বর্ধিত হয়; তজ্জন্য সত্যনিষ্ঠার সহিত সংকল্প করিয়া... এই সংবিধান গ্রহণ করিতেছি।”
দেখতে দেখতে আমাদের গর্বিত স্বাধীনতা ৭২ বছর অতিক্রম করে ৭৩ বছরে পা দিল। কষ্টার্জিত এই স্বাধীনতার ৭২ বছরের ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে যাওয়ার পরেও প্রশ্নের পর প্রশ্ন কি দলা পাকিয়ে উঠছে না আমাদের চেতনার দেওয়াল বেয়ে? কালের আবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সাধের ভারতরাষ্ট্র কি তার সংবিধানের প্রস্তাবনা এবং সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারগুলি সুনিশ্চিত করার লক্ষ্য থেকে ক্রমশই দূরে সরে যাচ্ছে না? ভারতকে ‘সমাজতান্ত্রিক’ রাষ্ট্র রূপে গড়ে তোলার লক্ষ্য থেকে বর্তমান রাষ্ট্র পরিচালকদের সমান্তরাল দূরত্ব বাড়িয়ে তোলার নিরন্তর চেষ্টার কতটুকুই বা বিরুদ্ধাচারণ করতে পারছি আমরা?
ভারতকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাষ্ট্র হিসেবে অটুট রাখার লক্ষ্য থেকে বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থার ক্রমাগত বিচ্যুতিকে শোধরানোর দায়ভারই বা কতটুকু নিতে পারছি আমরা?
একবিংশ শতাব্দীর নব্যযৌবনের দোরগোড়ার অলিন্দে দাঁড়িয়ে যখন অনুভূত হয় যে, ভারতের সংবিধানের ‘সহজ পাঠ’ প্রস্তাবনা সমূহ এবং মৌলিক অধিকারগুলি বাস্তবিকই অস্তিত্বের সঙ্কটে, তখন আমরা কেবলই ‘নীরব’ থেকে কতটাই বা ‘প্রাউড ইন্ডিয়ান’ হয়ে উঠতে পারছি! তেরঙ্গা জড়িয়ে বা ‘প্রাউড ইন্ডিয়ান’ বলে সদর্পে ঘোষণা করে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দেওয়ার হিড়িক দেখে দেশপ্রেমের বন্যা বয়ে চলেছে, এটা ভাবার কোনও যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি আছে বলে কিন্তু একেবারেই মনে হয় না। ‘প্রাউড ইন্ডিয়ান’ হওয়ার প্রাথমিক শর্তটা হল, ভারতের সংবিধানের প্রতি একনিষ্ঠ ভাবে শ্রদ্ধাশীল থাকা এবং দেশের জনতা রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনার ভার যাঁদের হাতে ন্যস্ত করেছে, তাঁরা দেশের সংবিধানের মূল ভিত্তিকে অক্ষুণ্ণ রাখতে চাইছে বা পারছে কি না, তা দায়িত্ব নিয়ে পর্যবেক্ষণ করা। অথচ, প্রায় প্রত্যহ প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে দেশের সরকার বা সরকার পরিচালনকারী রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ আমাদের গর্বের সংবিধানের মূল ভিত্তিকে অস্বীকার করার কাজে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দিয়েছে এবং তা দেখেও আশ্চর্যজনক ভাবে আমরা ‘নীরব ইন্ডিয়ান’ই থেকে যাচ্ছি। তখনও আমাদের নিজেদের ‘প্রাউড ইন্ডিয়ান’ হিসেবে জাহির করা কি আদৌ গ্রহণযোগ্য?
আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনশক্তি দেশের গৌরবমাখা সংবিধানের প্রস্তাবনার মূল মন্ত্র থেকে ক্রমাগত বিচ্যুত হওয়ার পথে পা বাড়িয়ে চলেছে। তা সে সমাজতান্ত্রিক ভারত গড়ার লক্ষ্যের ক্ষেত্রেই হোক বা ধর্মনিরপেক্ষ ভারতকে অক্ষুণ্ণ রাখার প্রয়াসের ক্ষেত্রেই হোক। একে তেরঙ্গার অপমান বলে মতপ্রকাশ করা হলে দেশদ্রোহিতার গন্ধ খোঁজার ধূর্ত কৌশল শুরু হয়ে যাবে না তো? স্বাধীনতা তো তখনই আপামর ভারতবাসীর কাছে সূর্যালোক নিয়ে আসবে, যখন সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার ধর্ম, জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে ভোগ করতে পারবে দেশের আপামর জনতা। যখন আমরা মর্মে মর্মে অনুভব করতে পারি যে, আমাদের দেশের রাষ্ট্র পরিচালকদের কর্মকাণ্ডের শরীর থেকে ক্রমশই খসে পড়ছে সহিষ্ণুতার পোশাকি বর্ম, নুইয়ে পড়েছে বহুত্ববাদের অনির্বচনীয় মন্ত্রের মেরুদণ্ড, তখনও কি আমরা নীরবতার আতস কাঁচে নিজেদের পরিবৃত রেখে ‘প্রাউড ইন্ডিয়ান’ হয়ে থেকে যেতে পারব!
ধর্মান্ধতা নির্ভর রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা যদি এমন ভাবে এক দিন সত্যি গ্রাস করে তিল তিল করে গড়ে ওঠা ‘বহুজন সুখায় চ, বহুজন হিতায় চ’-র এই মহামানবের দেশের বহুত্ববাদের কাঠামো, সে দিনও আমরা নীরবতার আগুনে ঝলসে ‘প্রাউড ইন্ডিয়ান’ হয়ে বাঁচতে পারব তো?
অসহিষ্ণুতার কদর্য উদাহরণের কালো মেঘে ক্রমশই ছেয়ে যাচ্ছে আমাদের সমগ্র জীবনের চালচিত্র। তা সে সঙ্কীর্ণ ধর্মীয় মেরুকরণের প্রেক্ষিতেই হোক বা রাজনৈতিক অথবা সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্কীর্ণতার প্রেক্ষিতেই হোক। এর মূল্য চোকাতে হবে না তো আমাদের বহু কষ্টার্জিত স্বাধীনতার মূল্যের বিনিময়ে! চরম অসহিষ্ণুতার নির্মম কুঠার বারংবার আছড়ে পড়ছে দেশের বহুত্ববাদের সহিষ্ণুতার কপালে। কোনও এক অজানা শক্তি যেন পাণ্ডুর করে রেখেছে আমাদের সকল সংবেদনশীলতা এবং সচেতনাকে। মনের জানালা দিয়ে হু-হু করে ঢুকে পড়া অস্থির বাতাস ক্রমশই তপ্ত করে তুলছে আমাদের সকল চেতনকে, মননকে।
তবু জেগে থাকে আশা। এই বিভাজনের সামাজিক এবং রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের মাঝেও যে মিলনের মন্ত্রোচ্চারণের শক্তিতে আমরা বাঁধা পড়ে আছি একই সুতোয়, সেই সর্বশক্তিমান মানবতাবাদের বলিষ্ঠ মন্ত্রোচ্চারণ আজও কিন্তু ঝরে পড়ে প্রতিটি স্বাধীনতা দিবসে তেরঙ্গা পতাকা উত্তোলনের মুহূর্তে। গুচ্ছ গুচ্ছ সুবাসিত ফুলের রামধনু আঁকা পাপড়ি বেয়ে বেয়ে।
লেখক: শিক্ষক, বেলডাঙা এসআরএফ কলেজ