প্রতীকী ছবি।
বিনা পয়সায় চারা বিলিয়ে বছরে ১০০ দিন কাজের প্রকল্পে ফল গাছের বাগান তৈরি করাতে উদ্যোগী হয়েছে নদিয়া জেলা প্রশাসন। কিন্তু যাঁরা ফলের চারা পাবেন, সেই উপভোক্তাদের তালিকা নিয়েই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে।
গত জানুয়ারির মাঝামাঝি নাগাদ জেলা প্রশাসন স্থির করে, ১০ কাঠা বা তার চেয়ে বেশি নিজস্ব জমি রয়েছে এমন উপভোক্তাদের ছোট উচ্চতার নারকেল, গন্ধরাজ লেবু, পেঁপে, কলা ও ড্রাগন ফলের চারা দেওয়া হবে। একই জমিতে এক সঙ্গে নারকেল ও লেবুর চারা বা নারকেলের সঙ্গে পেঁপে চারা লাগানো যাবে। ১০ কাঠা জমিতে ২৯টি নারকেল গাছের সঙ্গে লেবু ও পেঁপে লাগানো যেতে পারে। আবার কেবল মাত্র কলা গাছের চারাও লাগানো যাবে।
এই প্রকল্পে উপভোক্তাদের নাম নির্ধারণ করার কথা পঞ্চায়েতগুলির। প্রশাসনের নির্দিষ্ট করে দেওয়া সংস্থার মাধ্যমে চারা সংগ্রহ করার কথাও তাদেইর। কিন্তু একাধিক পঞ্চায়েতের নির্মাণ সহায়ক ও প্রধানদের মতে, কোনও অজ্ঞাত কারণে ব্লক ও জেলা প্রশাসন পুরো কাজটাই অস্বাভাবিক দ্রুততার সঙ্গে করতে চাইছে। জেলার বিভিন্ন পঞ্চায়েতকে গড়ে আড়াইশো জন করে উপভোক্তার নাম দিতে বলা হয়েছে। এত লোকের নাম ঠিক করতে অনেকটাই সময় লাগার কথা। কেননা গ্রাম সংসদের সভার মাধ্যমে নাম আসবে। নামের তালিকা পঞ্চায়েতের সাধারণ সভায় পাশ হলে তা যাবে ব্লক প্রশাসনের কাছে।
রানাঘাট ১ ব্লকের এক নির্মাণ সহায়ক জানাচ্ছেন, তালিকায় নাম থাকা উপভোক্তারা চারা লাগাতে আগ্রহী কি না তা যাচাই করতে হবে। তাতে সময় তো লাগবেই। তার উপরে যে কোনও জোহানের বরাত দেওয়ার আগে ‘স্কিম’ তৈরি করতে হয়। কিন্তু জেলা প্রশাসন তাড়াহুড়ো করে সে সবের তোয়াক্কা না করেই উপভোক্তার তালিকা তৈরি করিয়েছে বলে বেশ কিছু পঞ্চায়েতের কর্মী ও জনপ্রতিনিধিদের অভিযোগ।
এক নির্মাণ সহায়কের মতে, একটি পঞ্চায়েতে গড়ে আড়াইশো জন উপভোক্তার জন্য ‘স্কিম’ তৈরি করতে অন্তত দু’মাস সময় লাগে। কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, ব্লকগুলির কাছে থাকা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলা সদস্য ও প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার তালিকায় থাকা নাম দিয়ে গাছের চারা পাওয়ার উপভোক্তার তালিকা তৈরি করা হয়েছে। আদৌ তাঁদের জমি আছে কি না বা তাঁরা ধান, পাট, গমের চাষ ছেড়ে ফলের বাগান করবেন কি না, তা একেবারেই যাচাই করা হয়নি।
এমনও বহু লোক আছেন, যাঁরা নিজেরাও জানেন না যে তালিকায় তাঁদের নাম রয়েছে। এ রকম অনেকেই সোমবার চাপড়া ব্লক অফিসে এসেছিলেন। ওই ব্লকের হাতিশালা গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীন মহেশনগরের বাসিন্দা বক্কর আলি মণ্ডলের নাম তালিকায় রয়েছে। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমার সঙ্গে কথা না বলেই কেউ আমার নাম দিয়েছে। এখন ব্লক অফিসে ডেকে ফলের গাছ লাগানোর কথা বলা হচ্ছে। আমার তো এক বিঘা জমি, সেখানে এখন ধান লাগিয়েছে। ধান কাটার পরেও এ সব ফলের চারা লাগাতে পারব না। কারণ ওই এক বিঘায় ধান চাষ না করলে বছরভর চাল কিনে খেতে হবে।’’
ওই ব্লকেরই আলফা পঞ্চায়েতের ডোমপুকুরের বাসিন্দা, দেড় বিঘা জমির মালিক মহসিন মণ্ডলের নামও তালিকায় আছে এবং তিনিও ফলের চাষে অনাগ্রহী। আবার বাগবেড়িয়ার বাসিন্দা নাজিমুদ্দিন খান বলছেন, ‘‘আমার দু’বিঘা জমি রয়েছে। তার মধ্যে দেড় বিঘায় দু’এক দিনের মধ্যেই ধান লাগাব। জমি তৈরি হয়ে গিয়েছে। ১০ কাঠাতে রাই রয়েছে। এর পরে তিল বুনব। প্রশাসন আগে জানালে ফলের চারা লাগানো নিয়ে ভাবতাম।’’
বিডিও-দেরও অনেকে বলছেন, বহু লোকজনই ফলের বাগান তৈরিতে বিশেষ আগ্রহী নন। ফলে তাড়াহুড়ো করে এত উপভোক্তাকে গাছের চারা দিয়ে তেমন লাভ হবে না। রানাঘাট মহকুমার এক নির্মাণ সহায়কের দাবি, অনেক ব্লকই রাতে পঞ্চায়েতের চুক্তিভিত্তিক কোনও কর্মীকে ডেকে ব্লকের তৈরি তালিকা পঞ্চায়েতকে ই-মেল মারফত পাঠিয়েছে। তার পরে সেই কর্মীকে বলা হয়েছে, ফের ই-মেল করে তালিকাটি ব্লক অফিসে পাঠিয়ে দিতে— যাতে মনে হয় যে গ্রাম পঞ্চায়েতগুলিই নিজেরা যাচাই করে ওই তালিকা তৈরি করেছে এবং ব্লক অফিসে পাঠিয়েছে।
বেশ কিছু গ্রাম পঞ্চায়েতের কর্তারা জানাচ্ছেন, গত ৯ জানুয়ারি এই ‘স্কিম’-এ উপভোক্তা নির্ধারণের কথা বলা হয়েছিল। ১৮ জানুয়ারি আবার বলা হয়, ২০ তারিখের মধ্যে উপভোক্তার পুরো তালিকা বানাতে হবে। আর ৩০ জানুয়ারির মধ্যে জেলা প্রশাসনের নির্দিষ্ট করে দেওয়া তিনটি স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে চারা পাঠানোর বরাত দিয়ে দিতে হবে। অনেক গ্রাম পঞ্চায়েতেরই প্রধান এবং নির্মাণ সহায়কদের দাবি, তড়িঘড়ি তালিকা তৈরি করা ও দ্রুত বরাত দেওয়ার চক্করে এমন সব উপভোক্তার নাম তালিকায় ঢুকে পড়েছে, যাঁদের এ সব ফলের চারা লাগানোর কোনও ইচ্ছাই নেই। প্রয়োজনীয় জমিও নেই।
সোমবার নদিয়া জেলার ১০০ দিন কাজের প্রকল্পের নোডাল অফিসার অর্ণব রায়কে ফোন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর সফরের প্রস্ততির জন্য ব্যস্ত রয়েছি।’’ প্রশাসন সূত্রের খবর, ফলের চারা বিলি প্রকল্পের গোটা বিষয়টি নিজে পরিচালনা করছেন জেলাশাসক বিভু গোয়েল। রাতে তিনি বলেন, ‘‘উপভোক্তা জানেন না অথচ তাঁর নাম তালিকায় ঢুকে গেল, এমনটা হওয়ার কথা নয়। এই অভিযোগ যখন উঠছে, তদন্ত করে দেখব।’’