লোকসভা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর পরাজয়ের মাসুল গুনতে হয়েছে তৃণমূলের বেশ কয়েকজন নেতা-মন্ত্রীকে। কাউকে মন্ত্রিত্ব থেকে ছাঁটাই করে কাউকে বা দফতরবিহীন মন্ত্রী করে রেখে ‘শাস্তি’ দিয়েছে রাজ্যের শাসকদল।
সেই তালিকায় শেষ সংযোজন--মুর্শিদাবাদ জেলায় তৃণমূলের কোনও কমিটিতেই জেলার দুই প্রাক্তন মন্ত্রী, হুমায়ুন কবীর এবং সুব্রত সাহার ঠাঁই না হওয়া।
শুক্রবার বহরমপুরে দলের মুর্শিদাবাদ জেলা পর্যবেক্ষক ইন্দ্রনীল সেন এ সিদ্ধান্ত ঘোষণার পরেই ঘনিষ্ঠ মহলে হুমায়ুন জানিয়েছিলেন, এ ‘অপমান’ তিনি হজম করবেন না। শনিবার তাঁর ক্ষোভ উগরে দিয়ে হুমায়ুনের তাই প্রশ্ন, “কংগ্রেসের গড় মুর্শিদাবাদে এত লড়াইয়ের পরেও শুধুই অপমান? দলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে আমার ক্ষোভ স্পষ্ট করেই জানাব।” তারপর?
প্রাক্তন মন্ত্রী বলছেন, “প্রয়োজনে নতুন করে রাজনৈতিক জীবন শুরু করব।”
তাহলে কি পুরনো দল কংগ্রেসে ফিরছেন তিনি?
হুমায়ুন বলেন, “না, কংগ্রেসে নয়। সিপিএম আমার জাতশত্রু। ওখানেও নয়।” তাহলে কি বিজেপি?
দলের ডাকাবুকো নেতার কথায়, “আপত্তির তো কিছু নেই। বিজেপি-তে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারি। তবে সে ব্যাপারে জেলার বিভিন্ন ব্লকে আমার যাঁরা অনুগামী রয়েছেন তাঁদের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেব। প্রয়োজনে নতুন দলও গড়তে পারি, মুর্শিদাবাদ তৃণমূল কংগ্রেস।”
হুমায়ুনের দলত্যাগের সম্ভাবনা নিয়ে তৃণমূলের প্রভাবশালী নেতারা কেউই মন্তব্য করতে চাননি। তবে, দলের এক শীর্ষ নেতা বলেন, “আগে তো হুমায়ুন নিজের সিদ্ধান্তের কথা জানাক, তারপরে দল তার সিদ্ধান্তের কথা জানাবে।”
বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহও হুমায়ুনের দলত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশে অবাক। তিনি অবশ্য বলছেন, “উনি তো এখনও অন্য দলে, এর বেশি আর কী বলব!” প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী অবশ্য বলেন, “কে কোন দলে যোগ দেবে সেটা তার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার।”
শুক্রবার বহরমপুরে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে জেলায় বিভিন্ন কমিটির সদস্যদের নাম ঘোষণা করেন তৃণমূলের মুর্শিদাবাদ জেলা পর্যবেক্ষক তথা লোকসভা নির্বাচনে বহরমপুর কেন্দ্রের দলীয় প্রার্থী ইন্দ্রনীল সেন। নাম ঘোষণার পরেই ইন্দ্রনীল জানিয়ে দেন, যাঁদের নাম কমিটিতে নেই তাঁরা যেন বৈঠক ছেড়ে বেরিয়ে যান। এখানেই শেষ নয়, দলের অন্দরের খবর, বৈঠক শুরুর আগে জমা রাখা হয়েছিল নেতাদের মোবাইল। এমনকী ওই নেতাদের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে বলার আগে ইন্দ্রনীলের ‘হুঁশিয়ারি’ ছিল, সংবাদমাধ্যমের কাছে বৈঠক বা কমিটি গঠনের ব্যাপারে কোনও নেতার মন্তব্য দেখলে, সরাসরি তিনি দলনেত্রীর কাছে নালিশ জানাবেন।
হুমায়ুন বলেন, “কথায় কথায় দিদির জুজু দেখানো, এ কেমন অভদ্রতা! নেত্রী কি ওঁকে এমন হুঁশিয়ারি দিয়ে কথা বলার নির্দেশ দিয়েছেন?” তাঁর দাবি, বহরমপুরে অধীরের বিরুদ্ধে একজন ‘ডাকাবুকো রাজনৈতিক প্রার্থী’ চেয়েছিলেন তিনি। তিনি বলেন, “আমাকে প্রার্থী না করায় ক্ষোভ নেই। কিন্তু একজন অদক্ষ, অরাজনৈতিক ব্যক্তিকে প্রার্থী করায় আপত্তি জানিয়েছিলাম। তবে মনে রাখবেন, আমার দায়িত্বে থাকা রেজিনগর থেকেই তৃণমূল প্রার্থী সব থেকে বেশি ভোট পেয়েছিলেন।”
শুধু তাই নয়, দলের খোলনলচে বদলে যাঁদের হাতে জেলার দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছে তাদের অধিকাংশই ‘অরাজনৈতিক ব্যক্তি’ বলে দাবি হুমায়ুনের। তাঁর ক্ষোভ, “এক জনের বিরুদ্ধে তো মহিলা পাচারের অভিযোগও রয়েছে। এর দায় আমরা, যাঁরা জেলায় রাজনীতি করি তাদের নিতে হয়।”
রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে চিড় ধরতে শুরু করেছিল বছর দু’য়েক আগে। ২০১২ সালে ১২ নভেম্বর সরাসরি তৃণমূল ভবনে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে সে নালিশই জানিয়েছিলেন রেজিনগরের বিধায়ক হুমায়ুন। মমতার সায় মেলায় পরের দিন যোগ দিয়েছিলেন শাসকদলে। আর, দিন কয়েকের মধ্যেই অধীরের গড়ে ফাটল ধরানোর ‘পুরস্কার’ হিসেবে পেয়েছিলেন প্রাণিসম্পদ বিকাশ দফতরের প্রতিমন্ত্রীর পদ। তবে মাত্র সাড়ে চার মাসের জন্য। উপ-নির্বাচনে নিজের কেন্দ্রেই হেরে গিয়েছিলেন হুমায়ুন। মুখ্যমন্ত্রীর ‘প্রশ্রয়ে’ অবশ্য বিধায়ক পদ খুইয়েও অন্তত মাস দু’য়েক মন্ত্রিত্বের চেয়ার ছাড়তে হয়নি তাঁকে।
তবে লোকসভা নির্বাচনে দলের সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা থেকে আচমকাই বাদ পড়ে যান হুমায়ুন। প্রার্থী করা হয় ইন্দ্রনীলকে। অভিমানে তখন ‘রাজনৈতিক সন্ন্যাস’ নেওয়ার কথাও বলেছিলেন হুমায়ুন।
তবে এখন আর ‘সন্ন্যাস’ নয় ‘জবাব’ দেওয়ার কথা ভাবছেন হুমায়ুন।