প্রতীকী ছবি।
মূত্রথলিতে পাথর হয়েছিল বগুলার হরকুমার রায়ের। কলকাতার দুই বেসরকারি হাসপাতাল স্বাস্থ্যসাথী কার্ডে তাঁর অস্ত্রোপচার করতে চায়নি বলে অভিযোগ। তারা বলেছিল, নগদ টাকা দিয়ে অস্ত্রোপচার করতে হবে। এর পর রানাঘাটের একটি বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানান, তাঁরা স্বাস্থ্য সাথী কার্ড গ্রহণ করবেন। তবে ৪৫ হাজার টাকার প্যাকেজের মধ্যে ৩০ হাজার টাকা অস্ত্রোপচারের আগে নগদে দিতে হবে। বাকি ১৫ হাজার টাকা স্বাস্থ্যসাথী কার্ড থেকে কেটে নেওয়া হবে। অগত্যা তাতেই রাজি হতে হয় বাড়ির লোককে। হরকুমারবাবুর ছেলে হরসীত রায়ের কথায়, “বিএ পাশ করার পর কলার আড়তে সামান্য কাজ করি। ৩০ হাজার টাকা জোগাড় করতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে।”
এই অভিজ্ঞতা হরকুমারবাবুর একার নয়। রাজ্যজুড়ে স্বাস্থ্যসাথী কার্ড প্রত্যাখ্যানের অসংখ্য অভিযোগ মেলার পরেই অতি সম্প্রতি কড়া মনোভাব দেখিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জানিয়েছেন, স্বাস্থ্যসাথী কার্ড প্রত্যাখ্যান করা যাবে না এবং প্রত্যাখ্যান করলে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের বিরুদ্ধে এফআইআর করা যাবে।
এর পাল্টা যুক্তিও রয়েছে হাসপাতালগুলির কাছে। তাদের অভিযোগ, স্বাস্থ্যসাথীতে বিভিন্ন চিকিৎসা-প্যাকেজ এবং শয্যার যে টাকা সরকার নির্দিষ্ট করেছে সেটা অবাস্তব এবং তাতে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তার উপর, কিছু সংখ্যক স্বাস্থ্যসাথীর রোগী প্রত্যাখ্যান না করলে হাসপাতালের সব শয্যাতেই ওই প্রকল্পের রোগী ভর্তি রাখতে হবে। কেউ আর নগদ টাকা দিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা করাবেন না। তা হলে বেসরকারি হাসপাতাল চলবে কী ভাবে?
সরকার ও বেসরকারি হাসপাতালের এই টানাপড়েনের মধ্যে নাকাল হচ্ছেন সাধারণ মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষ। বিভিন্ন হাসপাতালে স্বাস্থ্যসাথী কার্ডে প্রত্যাখ্যাত হয়ে তাঁরাও ভাবছেন, এই প্রকল্প নিছক রাজনৈতিক প্রচারসর্বস্ব।
যেমন, নবদ্বীপ-লাগোয়া পূর্বস্থলীর বাসিন্দা ৮০ বছরের সন্ন্যাসী ঘোষ। মূত্রনালীর সমস্যার জন্য তাঁর অস্ত্রোপচার দরকার ছিল। নবদ্বীপ শহরের অধিকাংশ নার্সিংহোম জানিয়ে দেয়, ওই অস্ত্রোপচার তারা করে না। কারণ, স্বাস্থ্য দফতরের মাপকাঠিতে সব ক’টি ‘সি’ গ্রেড নার্সিংহোম। সেখানে অ্যাপেনডিক্স, গলব্লাডার বা হিস্টেকটমির বেশি কিছু হয় না।
শেষ পর্যন্ত রানাঘাটের একটি নার্সিংহোমে অস্ত্রোপচারে রাজি হয়, কিন্তু স্বাস্থ্যসাথী কার্ড নিতে তারা রাজি হয় না! অস্ত্রোপচারের জন্য নগদ ৩০ হাজার টাকা লাগবে বলে তারা জানিয়ে দেয়। শেষে অনেক আলাপ-আলচনার পর ৩০ হাজারের মধ্যে স্বাস্থ্যসাথী কার্ড থেকে ১৮ হাজার টাকা নিয়ে বাকি টাকা নগদে নেন নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষ।
কৃষ্ণনগরের বাগদিপাড়ার শ্যামল সরকার পায়ের অস্ত্রোপচারের জন্য গিয়েছিলেন কলকাতায়। সেখানে একাধিক হাসপাতালে যোগাযোগ করলেও কেউ স্বাস্থ্যসাথী কার্ড নিতে রাজি হয়নি বলে অভিযোগ। শেষে নগদ ১ লক্ষ ৬৫ হাজার টাকা দিয়েই তাঁকে অস্ত্রোপচার করতে হয়।
একই অভিজ্ঞতা কৃষ্ণনগরের হাতারপাড়ার বাসিন্দা দিব্যেন্দু বসুরও। তাঁর মা অঞ্জুলা বসুর মাথায় টিউমার অপারেশনের জন্য কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ করেছিলেন। তারা জানিয়ে দেয়, স্বাস্থ্যসাথী কার্ড নিতে তারা রাজি। কিন্তু অস্ত্রোপচারের জন্য স্বাস্থ্য ভবনে আবেদন করতে হবে। অনুমোদন মিললে তবেই অস্ত্রোপচার হবে। সেই অনুমোদন আসতে তিন থেকে ছয় মাস পর্যন্ত লেগে যেতে পারে!
অত দিন অপেক্ষা অসম্ভব বুঝে বাধ্য হয়ে সাড়ে চার লক্ষ টাকা খরচ করে মায়ের অস্ত্রোপচার করান দিব্যেন্দুবাবু। এর পরে অঞ্জুলাদেবীর ক্যানসার ধরা পড়ে। অভিযোগ, কলকাতার একটি বড় বেসরকারি ক্যানসার হাসপাতাল তাঁদের জানায় যে, তারা স্বাস্থ্য সাথী কার্ডকে মান্যতা দেয় না!
(চলবে)