ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য
এ জ্বর কেমন জ্বর!
শিশু থেকে বৃদ্ধ—রেহাই নেই কারও। কেউ স্কুল থেকে ফিরে প্রথমে জানাল, গলায় ব্যথা। বিকেলে ফুটবল পিটিয়ে সন্ধ্যায় ধুম জ্বর। থার্মোমিটারের পারদ ওঠানামা করছে ১০২-১০৩। কেউ আবার ভোরের দিকে টেনে নিয়েছিলেন চাদর। সকালে চা খাওয়ার সময় মুখটা বিস্বাদ। তারপর শীতটা ক্রমে বাড়তে বাড়তে বর্ষার ইলিশ-খিচুড়ি ফেলে ফের কাঁথার আশ্রয়।
নাড়ি টিপে গম্ভীর মুখে চিকিৎসকেরা বলছেন, ‘‘এ তো ভাইরাল কেস! দিন পাঁচ-সাতেকের আগে রেহাই নেই।’’ অগত্যা বেজার মুখে বাড়িতে বসে ওষুধ আর বিশ্রাম। করিমপুর থেকে কল্যাণী, বহরমপুর থেকে বাহাদুরপুর, কৃষ্ণনগর থেকে কান্দি, জলঙ্গি থেকে জঙ্গিপুর, মাসখানেক থেকে জ্বরের ধুমে কাঁপছে দুই পড়শি জেলা, নদিয়া ও মুর্শিদাবাদ।
মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ৬০-৭০ জন রোগী এসেছেন জ্বর নিয়ে। শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে গত এক সপ্তাহে সংখ্যাটা ৮০০। মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সুপার সুহৃতা পাল বলছেন, ‘‘আতঙ্কিত হয়ে অনেকেই হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। কিন্তু ভাইরাল জ্বর হলে আতঙ্কিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। হাসপাতালে ভাইরাল জ্বরে আক্রান্ত রোগীর কাছ থেকে সাধারণ রোগীদের মধ্যে ওই রোগের সংক্রমণ ঘটার একটা সম্ভাবনা থেকে যায়। ফলে বাড়িতে থেকেই চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে ওষুধ খেলে এবং কিছু নিয়মকানুন মেনে চললেই ভাইরাল জ্বর সেরে যায়।’’
কিন্তু চিকিৎসকেরা যাই বলুন, বর্ষার শুরুতেই এই জ্বরে হিমসিম খাচ্ছেন শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলেই। ইদের সকালে নমাজ সেরে বাড়ি ফিরেই ডোমকলের ইনতাজুদ্দিন বিশ্বাস দেখেন এক বছরের ছেলের ধুম জ্বর। সেই সঙ্গে নাগাড়ে কেঁদেই চলেছে শিশুটি। ইদের উৎসব মাথায় উঠল। ছেলেকে নিয়ে তিনি ছুটলেন ডোমকল মহকুমা হাসপাতালে। চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খাইয়ে জ্বর তো কমল চার-পাঁচ দিন পরে। কিন্তু ছেলের জ্বর ভাল হতেই একে একে বিছানায় পড়লেন বড় মেয়ে, স্ত্রী, তারপর তাজউদ্দিন নিজে। বেজার মুখে তাজউদ্দিন বলছেন, ‘‘ধন্যি জ্বর মশাই! বাড়ির সবাইকে কাবু করে দিল। জ্বর গেল বটে, কিন্তু দুর্বলতা এখনও থেকেই গেল। মুখে কোনও স্বাদ নেই।’’
আর কৃষ্ণনগরের সুব্রত ভট্টাচার্য একমাত্র ছেলের জ্বর নিয়ে এতটাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন যে তিন দিন অফিস যেতে পারেননি। চিকিৎসক দেখিয়ে, ওষুধ খাইয়ে জ্বর ১০২-১০৩ এর নীচে নামছিলই না। চিকিৎসকের পরামর্শে রক্ত পরীক্ষাও করানো হয়। কিন্তু সেখানেও সব কিছু স্বাভাবিক। মঙ্গলবার বিকেলে জ্বরটা একটু কমতেই স্বস্তি ফিরেছে ভট্টাচার্য পরিবারে। সুব্রতবাবু বলছেন, ‘‘খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলাম জানেন। স্কুল থেকে ফিরে প্রথমে বলল গলা ব্যথা। তারপর বিকেলে মাঠ থেকে ফিরেই জ্বর।’’
শক্তিনগর জেলা হাসপাতালের সুপার সুদীপ সরকারও বলছেন, ‘‘এই সময় প্রতি বছরই জ্বরের প্রকোপ দেখা দেয়। অযথা চিন্তিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। আমাদের হাসপাতালেও জ্বর নিয়ে প্রচুর রোগী আসছেন। আমরাও তৈরি আছি।’’ হাসপাতাল সূত্রে খবর, গত এক সপ্তাহে প্রায় আটশো জন জ্বর নিয়ে চিকিৎসা করাতে এসেছেন। তাঁদের মধ্যে ৭০ জন টাইফয়েডের রোগী ও ৮০ জন নিউমোনিয়ার রোগী। বাকিরা সকলেই ভাইরাল জ্বরে আক্রান্ত।
মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক কৃষ্ণ সেন জানাচ্ছেন, ভাইরাল জ্বরের উপসর্গ হচ্ছে রোগীর শরীরে হালকা জ্বর থাকে। সেই সঙ্গে গলায় ব্যথা, নাক দিয়ে জল পড়া, হাঁচি-কাশি, সারা শরীর ও মাথায় ব্যথা করে। চোখ লাল হয়ে যায়। রোগী খুব দুর্বল হয়ে পড়ে। হাত-পা ব্যথার ফলে রোগী স্বাভাবিক ভাবে চলাফেরাও করতে পারেন না। প্রাথমিক ভাবে ওই উপসর্গ দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ খাওয়া এবং বিশ্রাম নেওয়া উচিত।
চিকিৎসকদের পরামর্শ, ভাইরাল জ্বরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ফলে অনেক সময়ে নিউমোনিয়া এবং পেটের সমস্যা দেখা দিতে পারে। তবে ভাইরাল জ্বর সংক্রামক। বাড়িতে কারও ভাইরাল জ্বর হলে অন্য সদস্যদের বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের রোগী থেকে দূরে থাকা উচিত। এই জ্বরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার সঙ্গে হজম ক্ষমতাও চলে যায়। রোগীর খিদেও কমে যায়। অনেক সময়ে বমি বমি ভাব থাকে। তাই খুব বেশি ঠান্ডা খাবার, মশলাযুক্ত খাবার এবং শক্ত খাবার খাবেন না। এই সময়ে সহজপাচ্য খাবার দিতে হবে রোগীকে।