দখল হয়ে গিয়েছে ফুটপাত। কৃষ্ণনগরে। নিজস্ব চিত্র
সদর মোড় থেকে সিএমএস স্কুলের দিকে যাচ্ছিলেন বছর চল্লিশের এক মহিলা। সঙ্গে তাঁর মেয়ে। উল্টো দিক থেকে ধেয়ে আসা লরিকে জায়গা ছাড়তে গিয়ে দেখেন, সেটির পিছন থেকে আবার আসছে একটা মোটরবাইক।
মা-মেয়ে যান কোথায়?
রাস্তার পাশে ফুটপাত বলে যে কিছুই নেই! ফুটপাত দখল করে নিয়েছে দোকান। রাস্তার উপরেই সার দিয়ে রাখা মোটরবাইক, সাইকেল। শেষ পর্যন্ত বাইক-আরোহী কোনও মতে পরিস্থতি সামলে নিতে পারলেও হালকা ধাক্কা লাগে মহিলার গায়ে।
এটা এখন গোটা কৃষ্ণনগর শহরের স্বাভাবিক চিত্র। ফুটপাত সব হাওয়া। এক দিকে শহরের রাস্তায় শুধু টোটো নয়, লাফিয়ে বাড়ছে অন্য গাড়ির সংখ্যাও। আছে বেপরোয়া বাইক আরোহীদের আতঙ্কও। আর তার সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে ‘চুরি’ হয়ে যাচ্ছে শহরের ফুটপাত। তার জেরে ছোটখাটো দুর্ঘটনা লেগেই আছে। তেমনই শহরের গতিও অনেকটা শ্লথ হয়ে আসছে।
এমনিতে কৃষ্ণনগর শহরের বেশির ভাগ রাস্তা অনেকটাই সঙ্কীর্ণ। তার উপরে দীর্ঘদিন ধরে ফুটপাতও একটু-একটু করে দখল করছে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। বছর কয়েক আগে কৃষ্ণনগর পুরসভার তরফে ফুটপাত দখলমুক্ত করার জন্য অভিযান চালানো হয়েছিল। কিন্তু মাঝপথে রণে ভঙ্গ দেয় তারাও। ফলে পরিস্থিতি আরও কঠিন আকার নিয়েছে।
গোদের উপরে বিষফোঁড়া, সদর মোড় থেকে জেলা সদর হাসপাতালের গা ঘেঁষে তৈরি হয়েছে দোতলা মার্কেট কমপ্লেক্স। তাতেও রাস্তা অনকেটাই ছোট হয়ে এসেছে বলে শহরবাসীর অনেকেরই দাবি। মার্কেট কমপ্লেক্সের সামনে ফুটপাত তৈরি করা হলেও তা দখল করে নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। একই অবস্থা এভি স্কুলের মোড় থেকে নেদেরপাড়া মোড়ের রাস্তাতেও। এই রাস্তায় কোনও ফুটপাতই নেই। প্রায় রাস্তার উপরে চলে আসা দোকানের সামনে বিপজ্জনক ভাবে দাঁড় করিয়ে রাখা হয় মোটরবাইক, সাইকেল, এমনকি গাড়িও। নেদেরপাড়া মোড় থেকে স্টেশনের রাস্তাও একই রকম ফুটপাতহীন। দোকানগুলো ক্রমশ সামনের দিকে এগিয়ে আসায় রাস্তা ক্রমশ সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়ছে। অথচ ওই সব রাস্তা দিয়ে অবিরাম চলাচল করছে বাস-লরিও।
স্বাভাবিক ভাবেই, ফুটপাত না থাকায় নিত্যদিন দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে পথচলতি মানুষজনকে। অনেকেই উৎসবের দিনগুলোয় গাড়ির ধাক্কা খেতে-খেতে বেঁচে গিয়েছেন। শহরের বাসিন্দা দুলাল সরকার বলছেন, “ফুটপাত না থাকায় দুর্গাপুজোর দিনগুলোয় মানুষকে চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হয়েছে। ভাবতেই পারছি না, জগদ্ধাত্রী পুজোয় কী হবে!”
পরিস্থিতি যে ক্রমশ খারাপ হচ্ছে তা স্বীকার করে নিচ্ছেন কৃষ্ণনগর পুসভার কর্তারাও। তার পরেও কেন ফুটপাত ফাঁকা করা হচ্ছে না? কেন আগের বার মাঝপথে অভিযান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল? পুরপ্রধান অসীম সাহার বক্তব্য, “আমরাও বুঝতে পারছি, পরিস্থিতি খারাপ। সেই কারণেই আমরা অভিযান শুরু করেছিলাম। কিন্তু স্থানীয় বিধায়ক আপত্তি তোলায় আমরা অভিযান বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছি।”
পুরপ্রধান তৃণমূলের জনপ্রতিনিধি, কৃষ্ণনগর উত্তর কেন্দ্রের বিধায়ক অবনীমোহন জোয়ারদারও তা-ই। তাঁর পাল্টা দাবি, “আমি ফুটপাত দখলমুক্ত করার বিরোধিতা করিনি। বরং আমার উদ্যোগেই ঝুপড়ি দোকান তুলে দিয়ে পাকা স্থানীয় মার্কেট কমপ্লেক্স তৈরি হচ্ছে।”
পুরসভা আর বিধায়কের মধ্যকার এই টানাপড়েনে ক্রমশ আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠছে শহরের মানুষের জীবন। এর হাত থেকে কি তা হলে কোনও ভাবে মুক্তি পাওয়ার সম্ভবনা নেই? পুরপ্রধান বলেন, “এ বার আমরা আর উদ্যোগী হব না। প্রশাসন যদি উদ্যোগী হয় তা হলে আমরা সব রকম ভাবে সহযোগিতা করব।”
কৃষ্ণনগর সদর মহকুমাশাসক অম্লান তালুকদার বলেন, “বিষয়টি নিয়ে আমি জগদ্ধাত্রী পুজোর আগেই পুর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করব। কিন্তু ফুটপাত ওঁদেরই দখলমুক্ত করতে হবে। আমরা সহযোগিতা করতে সব রকম ভাবে প্রস্তুত।”
অর্থাৎ মুখে যে যা-ই বলুন, কোনও তরফই বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধতে রাজি নন। জগদ্ধাত্রী পুজো আর তাপ পরেও যে দুর্ভোগ চলতেই থাকবে, তা কার্যত ধরেই নেওয়া যায়।