১৯৭৬ সালে শহর জুড়ে চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা। সেই আবহেই স্থানীয় সাংস্কৃতিক কর্মীরা গড়ে তোলেন নবদ্বীপ নাট্য উন্নয়ন পরিষদ নামে এক যৌথ মঞ্চ। দলমত নির্বিশেষে সব বয়সের সাংস্কৃতিক কর্মীদের আন্তরিক প্রচেষ্টা শহরে বয়ে আনে মুক্ত বায়ু। আধুনিক বাংলা নাটকের আঁতুড়ঘর নবদ্বীপ ফিরে পায় চেনা ছন্দ।
গত ১৮ মার্চ শুক্রবার সেই নাট্য উন্নয়ন পরিষদ উদ্যোগী হয়ে শুরু করেছিল এক নাট্যোৎসব। শেষ হল ২২ মার্চ, মঙ্গলবার। পাঁচদিনে মোট চোদ্দটি একাঙ্ক নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে।
স্বয়ং চৈতন্যদেবের হাত ধরে নবদ্বীপ থেকেই আধুনিক বাংলা নাটক মঞ্চায়নের সূত্রপাত বলে নবদ্বীপের মানুষ গর্ব করেন। চৈতন্যদেবের নাট্যাভিনয়ের পরবর্তী পাঁচশো বছরেরও বেশি সময় ধরে নবদ্বীপ মঞ্চাভিনয়ের অনেক বাঁক, অনেক ওঠাপড়া, অনেক ভাঙাগড়ার সাক্ষী থেকেছে। নাট্যমঞ্চের অভাব, মান্ধাতার আমলের আলো, শব্দের আয়োজন। মেকআপ ও পোশাকের নামমাত্র বন্দোবস্ত। স্থানীয় ডেকরেটরকে দিয়ে করা সেটসেটিং নিয়ে নিধিরাম সর্দারের মতো শুধু মাত্র ইচ্ছেটুকু সম্বল করে ঢাল তরোয়াল ছাড়াই নাটক করেছেন নবদ্বীপের নাট্যকর্মীরা। বহু টাকা ব্যয় করে রাধাবাজার পার্কের খোলা মাঠে ম্যারাপ বেঁধে কলকাতা থেকে নিয়মিত ভাবে এনেছেন ভাল নাটক। বজায় রেখেছেন নাট্যচর্চার ধারাবাহিক অভ্যাস। স্থানীয় পুরসভার একটি অত্যাধুনিক নাট্যমঞ্চের কল্যাণে নবদ্বীপের নাট্যচর্চার এখন বড় সুখের সময়। এক দিকে, সমকালীন বাংলা নাটকের জনপ্রিয় প্রযোজনাগুলি নিয়মিত দেখার সুযোগ পেয়েছেন নবদ্বীপের নাটকপ্রেমী মানুষ। পাশাপাশি একটি আধুনিক নাট্যমঞ্চ স্থানীয় নাটকের দলগুলিকে নিজেদের প্রযোজনা নিয়ে নিশ্চিন্তে পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। দু’বছর আগেও নবদ্বীপ নাট্য সম্মেলন শেষ হত অস্থায়ী মঞ্চ থেকে সমবেত ধ্বনিতে, “নাটক নাটক নাটক চাই। নাটক করার মঞ্চ চাই।” সেই মঞ্চ এখন প্রস্তুত। যে মঞ্চের সুখ্যাতি নবদ্বীপ ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে খোদ কলকাতার নাট্যজগতে। রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, দেবশঙ্কর হালদার, গৌতম হালদারের মতো অভিনেতার এই মঞ্চের প্রশংসা করেছেন।
শুক্রবার ১৮ মার্চ চল্লিশতম নাট্য সম্মেলনের উদ্বোধন করে অভিনেতা পরিচালক রঞ্জন রায়। তিনি বলেন, “এই মঞ্চের কথা কলকাতায় দেবশঙ্কর হালদার আমায় বলেছেন। এমন একটি মঞ্চে স্থানীয় নাট্যদলগুলি প্রাণ খুলে কাজ করতে পারবেন। আশা করব নাট্যচর্চার সুদীর্ঘ ঐতিহ্যবাহী নবদ্বীপ শহরের মানুষ স্থানীয় দলের নাটক দেখতে নিয়মিত ভিড় জমাবেন চমৎকার এই হলে।”
পাঁচদিনের এই নাট্যোৎসবে সেই অর্থে ছিল না কোনও তারকা আকর্ষণ। কী অভিনেতা, কী দল—উভয় ক্ষেত্রেই সেলিব্রিটি বলতে যা বোঝায় তা বাদ দিয়েই আয়োজন করা হয়েছিল নাট্য সম্মেলনের। কলকাতার নামী দলের নাটক দেখতে কিম্বা গত ডিসেম্বরে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের পশ্চিমবঙ্গ নাট্য অ্যাকাডেমির উদ্যোগে অন্তবঙ্গ নাট্য উৎসবের মতো দর্শক উপচে পড়েনি প্রেক্ষাগৃহে। সাড়ে আটশো আসনের নবদ্বীপ রবীন্দ্র সাংস্কৃতিক মঞ্চে বেশ কিছু আসন ফাঁকা থেকেছে রোজই।
এখানেই কপালে ভাঁজ পড়েছে শহরের নাট্যকর্মীদের। ‘মাধবী’ কিম্বা ‘রুদ্ধসঙ্গীতের’ জন্য যে ভাবে এ শহরের মানুষ রাস্তায় লাইন দেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘ফেরার’ টিকিট যে ভাবে তিনদিনে উড়ে যায়, সেই ভাবেই তারা হল ভরিয়ে কেন তোলেন না অন্য নাটক দেখার জন্য? মঞ্চের অভাব মিটেছে। নবদ্বীপ নাট্য উন্নয়ন পরিষদের নতুন চ্যালেঞ্জ ভাল নাটক এবং প্রকৃত দর্শক তৈরি করা।