—প্রতীকী চিত্র।
ঘটনা ১
টোটো থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে কোলের বাচ্চাকে সামলে অপর্ণা মজুমদার দেখলেন, মানি পার্সটা নেই। এ দিক ও দিক খোঁজ করেও সন্ধান মেলেনি।
ঘটনা ২
শহরের অভিজাত বস্ত্র প্রতিষ্ঠান থেকে ভিড় ঠেলে পুজোর বাজার সেরে হাতের ব্যাগ ফুটপাতে নামিয়ে টোটোর জন্য অপেক্ষা। কয়েক মুহূর্ত পর টোটোতে উঠতে গিয়ে শ্রীময়ী ভট্টাচার্য দেখলেন তিনটির বদলে আছে দু’টি ব্যাগ। দোকানে খোঁজ করেও সন্ধান মেলেনি ওই ব্যাগের। অন্য দোকানের সিসিটিভির ফুটেজ খতিয়ে দেখা যায় অল্পবয়সী এক কিশোরী অভিনব কায়দায় ব্যাগটি নিয়ে ভিড়ে মিশে গিয়েছে।
ঘটনা ৩
পোস্ট অফিস মোড়ের জুতোর দোকানে হাতের মোবাইল পাশে রেখে পছন্দসই জুতো পরখ করে দেখছিলেন বছর পঁয়ত্রিশের স্কুলশিক্ষক আকাশ চৌধুরী। হঠাৎই খেয়াল করলেন, মোবাইলটি আর সেখানে নেই! সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখা যায় তার পাশেই বসে থাকা আর এক ক্রেতা মিনিটখানেক আগেই মোবাইল নিয়ে সটান বেরিয়ে গিয়েছেন। মোটরবাইক করে এ দিক ও দিক খোঁজাখুঁজি করেও আর ওই যুবকের সন্ধান পাওয়া যায়নি। পাওয়ার কথাও নয় কারণ কৃষ্ণনগরের প্রাণকেন্দ্র পৌরসভা থেকে পোস্ট অফিস মোড় হয়ে হাই স্ট্রিট পর্যন্ত থিক থিকে ভিড়। নেই মাছি গলবার জায়গাও। এই ভিড়কে কাজে লাগিয়ে সক্রিয় কেপমারি গ্যাং।
প্রায়ই এই ধরনের অভিযোগ আসছে পুলিশের কাছে। পুলিশি সতর্কতা বাড়লেও অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে নাজেহাল পুলিশ। তাই সাবধান হওয়ার পাঠ দিচ্ছে প্রশাসন।
পুলিশের দাবি, দোকান, শপিং মল কিংবা ফুটপাতের ক্রেতার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে ওই কেপমারি গ্যাংয়ের সদস্যেরা। কোনও নির্দিষ্ট এক বা দু’জন ক্রেতাকে টার্গেট করে তাঁর উপরেই চলছে নজরদারি। ক্ষণিকের অসাবধানতার সুযোগ পেলেই চোখের নিমেষে গায়েব হয়ে যাচ্ছে মানি পার্স, মোবাইল, নতুন কেনা পোশাকের ব্যাগ। দোকানের সিসিটিভি ফুটেজে ঘটনার ছবি ধরা পড়লেও অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না কেপমারদের। তাই ক্রেতাদের সতর্ক হওয়ার নিদান দিচ্ছে পুলিশ ও প্রশাসন।
কী ভাবে চলছে এই কেপমারি?
ধৃত দু’জন কেপমারকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ জানতে পেরেছে, দক্ষ কুড়ি থেকে তিরিশ জনের অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের ওই গ্যাংটি পুজোর বাজারে অপারেশন চালাতে শহরে আস্তানা গেড়েছে। শহরের ব্যস্ততম এলাকাগুলি বেছে নিয়ে তিনটে দলে ভাগ হয়ে তারা এই কেপমারি চালাচ্ছে। একটি দলে সর্বোচ্চ দুই থেকে তিন জন সদস্য থাকছেন। যাঁদের বেশির ভাগই মহিলা। তাঁদের অনেকের কাছেই বাচ্চা আছে বলে জানা গিয়েছে। শিশু কোলে একই টোটোতে বসে শিশুকে অন্য যাত্রীর কোলে দিয়ে ব্যাগ বদল করে নিচ্ছেন এই মহিলা কেপমাররা। কেতাদুরস্ত পোশাকে অভিজাত বস্ত্র প্রতিষ্ঠানগুলিতে ঢুকে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে অভিনব কায়দায় চোখের নিমিষে ক্রেতাদের মানি পার্স ও মোবাইল ‘ভ্যানিশ’ করে দিচ্ছেন এই কেপমাররা। কোনও রকম অপ্রীতিকর পরিস্থিতি হলে সামাল দেওয়ার জন্য এক একটি চত্বরে হাজির থাকছে চার থেকে পাঁচ জনের কেপমারদের রেস্কিউ টিম।
পুজোর সময় অতিরিক্ত ভিড়ে মিশে থাকা কেপমারদের আলাদা করে চিহ্নিত করতে সমস্যা হচ্ছে পুলিশের। পুজোর ভিড়ে সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখাতে উৎসাহীও নন দোকানদাররাও। অনেক ক্ষেত্রে কেপমারির শিকার হলেও পুলিশি তদন্তে সহযোগিতা করছেন না ক্ষতিগ্রস্তরা। তবুও পুজোর বাজারে কৃষ্ণনগরের কেপমার গ্যাংদের নিয়ন্ত্রণে আনতে নজরদারি বাড়িয়েছে কৃষ্ণনগর জেলা পুলিশ। শহরের ব্যস্ততম অঞ্চলগুলিতে বাড়ানো হয়েছে পুলিশি নিরাপত্তা। মহিলা পুলিশ মোতায়েন থাকছে শহরের গুরুত্বপূর্ণ পোস্টগুলিতে। কেপমারি সংক্রান্ত কোনও অভিযোগ এলেই তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নিচ্ছে পুলিশ। তবে কোনওটাই পর্যাপ্ত নয় বলে দাবি পুলিশকর্তাদের। তাঁদের পরামর্শ, একমাত্র ক্রেতাদের সতর্কতাই রক্ষা করতে পারে এই কেপমার চক্র থেকে। কেপমারি গ্যাংয়ের বাড়বাড়ন্ত দেখে উদ্বেগ বাড়ছে ক্রেতাদের মনেও। উদ্বিগ্ন ক্রেতারা চাইছেন বাড়ুক পুলিশি নিরাপত্তা, আরও কঠোর হোক নজরদারি।
কৃষ্ণনগরের প্রসিদ্ধ এক বস্ত্রবিপণির কর্ণধার বলেন, “আমাদের দোকানে খুব বেশি এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। সিসিটিভিতে সব আছে। কিন্তু এই ভিড়ে আমাদের সময় কোথায় যে সিসিটিভি ফুটেজ বার করে দেখব? ক্রেতাদের একটু সতর্ক হতে হবেই।”
মানি পার্স খোয়ানো মধ্যবয়সী মহিলা অপর্ণা মজুমদার বলেন, “এ ভাবে যদি পকেটমার মাছির মতো লেগে থাকে তা হলে আমরা সতর্ক থেকেই বা লাভ কী? পুলিশকে অবিলম্বে এই গ্যাং ধরতে হবে না হলে কৃষ্ণনাগরিকদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হবে না।”
কৃষ্ণনগর পুলিশ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সঞ্জয় মিত কুমার বলেন, “ভিড়কে কাজে লাগিয়ে চুরি, ছিনতাই-এর মতো ঘটনা ঘটে। অতিরিক্ত পুলিশি নিরাপত্তা বাড়িয়ে এই ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে।”