ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত পাঠান আমলের খেরুর মসজিদ

টেরাকোটার কারুকার্যে আগাগোড়া সজ্জিত হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির সমন্বয়ে নির্মিত পাঠান আমলের খেরুর মসজিদটি ভূমিকম্পের অভিঘাতে ধ্বংসের মুখে। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ওই মসজিদের প্রধান গম্বুজটি ভেঙে গিয়েছে। এ বছর ২৫ ও ২৬ এপ্রিলের ভূমিকম্পে বড় বড় বেশ কয়েকটি ফাটল ধরেছে। মসজিদটি পূর্ব দিকে ও দক্ষিণ দিকে হেলে গিয়েছে।

Advertisement

অনল আবেদিন

সাগরদিঘি শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০১৫ ০১:৩৭
Share:

ভূমিকম্পের জের। সাগরদিঘিতে হেলে গিয়েছে প্রাচীন এই মসজিদ। গৌতম প্রামাণিকের তোলা ছবি।

টেরাকোটার কারুকার্যে আগাগোড়া সজ্জিত হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির সমন্বয়ে নির্মিত পাঠান আমলের খেরুর মসজিদটি ভূমিকম্পের অভিঘাতে ধ্বংসের মুখে। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ওই মসজিদের প্রধান গম্বুজটি ভেঙে গিয়েছে। এ বছর ২৫ ও ২৬ এপ্রিলের ভূমিকম্পে বড় বড় বেশ কয়েকটি ফাটল ধরেছে। মসজিদটি পূর্ব দিকে ও দক্ষিণ দিকে হেলে গিয়েছে। ফলে যে কোনও সময় মসজিদটি ভেঙে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

Advertisement

ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বিভাগের সংরক্ষিত খেরুর গ্রামের ওই ‘এক গম্বুজ মসজিদ’ এখন থেকে ৫২০ বছর আগে ১৪৯৫ খ্রিস্টাব্দে সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের আমলের। ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বিভাগের কলকাতা মণ্ডলের পুরাতত্ত্ববিদ গৌতম হালদার বলেন, ‘‘আর কোথাও টেরাকোটার সজ্জায় অলঙ্কৃত এ রকম কোনও মসজিদ রয়েছে বলে অন্তত আমার জানা নেই।’’

মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরদিঘি থানার শেখদিঘি গ্রাম লাগোয়া ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের মোড় থেকে দক্ষিণ-পূর্বে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে খেরুর গ্রাম। ওই গ্রামের একটি ক্লাবঘর নির্মাণের সময় ১৯৭৮ সালে মাটির এক মিটার নীচ থেকে পাওয়া যায় পাল-সেন যুগের কালো পাথরের একটি স্থানক বিষ্ণুমূর্তি। দুই ইতিহাস গবেষক বিজয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ও অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের লেখা ‘পশ্চিমবঙ্গের পুরাসম্পদ’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘‘খেরুর গ্রামটি প্রাচীন। হিন্দু-বৌদ্ধ যুগেও গ্রামটির অস্তিত্ব ছিল। সুলতানি আমলেও এটি একটি প্রসিদ্ধ জনপদ ছিল বলে মনে হয়।’’ ওই গ্রামের বেশ উঁচু একটি ঢিবির উপর পূর্বমুখী মসজিদটি নির্মাণ করেন সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের সেনাপতি মুয়াজ্জম খাঁ। মসজিদের সামনের দেওয়ালের মূল প্রবেশদ্বারের উপর নিবদ্ধ রয়েছে কালো পাথরের দু’টি ফলক। তাতে আরবি হরফে মসজিদটির নির্মাণ কাল খোদাই করা রয়েছে। চুন-সুরকির গাঁথনিতে বাংলা ইট দিয়ে মসজিদটি নির্মিত হয়। ভিতরে, বাইরে, দেওয়ালে, ও খিলান মিলে সমগ্র মসজিদটি টেরাকোটার ফুল ও লতাপাতায় অলঙ্কৃত।

Advertisement


ফাটল ধরেছে মিনারে।—নিজস্ব চিত্র।

মসজিদটি দু’টি প্রকষ্ঠে বিভক্ত। পূর্বদিকে রয়েছে তিনটি প্রবেশদ্বার। তারপর বারান্দা। বারান্দার পর ফের তিনটি প্রবেশদ্বার। বারান্দার উপরে রয়েছে ৩টি গম্বুজ। বারান্দার পর পশ্চিমদিকে রয়েছে ৯ মিটার বাই ৯ মিটার আয়তনের মূল মসজিদ। মূল মসজিদের উপরে ছিল বিশালাকৃতির একটি গম্বুজ। এ কারণে ভারতীয় সর্বেক্ষণ বিভাগ নাম রেখেছে ‘এক গম্বুজ বিশিষ্ট খেরুর মসজিদ’। বিশালাকৃতির গম্বুজটি ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ভূমিকম্পে ভেঙে গিয়েছে। ছোট ৩টি গম্বুজে বিশাল বড় ফাটল ধরেছে গত ২৫ ও ২৬ এপ্রিলের ভূমিকম্পে। খিলান (আর্চ) দেওয়া সামনের ৬টি প্রবেশদ্বার ও দু পাশে, অর্থাৎ উত্তর ও দক্ষিণ দিকে আরও ২টি করে মোট ৪টি একই রকম খিলান দেওয়া প্রবেশদ্বার রয়েছে। সব মিলিয়ে ১০টি প্রবেশদ্বারের খিলানেই ফাটল ধরেছে। দক্ষিণ-পূর্ব কোনের ও দক্ষিণ-পশ্চিম কোনের মূল পিলার দু’টি দক্ষিণ দিকে হেলে পড়েছে। মসজিদটির পূর্বদিকের মূল তিনটি প্রবেশদ্বারেও উপরের অংশ সামনের দিকে প্রকৃত অবস্থা থেকে হেলে পড়েছে। সামনের অংশ প্রকৃত অবস্থার থেকে প্রায় ৬ ইঞ্চি হেলে পড়েছে।

ভেঙে পড়া থেকে ঐতিহাসিক ওই ঐতিহ্য রক্ষা করা তো দূরের কথা, ভূমিকম্পের ১২ দিন পরেও পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বিভাগের কোনও আধিকারিক সরেজমিনে খেরুর মসজিদ পরিদর্শন করেননি। মসজিদ দেখভালের জন্য রয়েছেন জাকির হোসেন নামে একজন কেয়ারটেকার। তিনি বলেন, ‘‘ভূমিকম্পে খেরুর মসজিদের কোনও ক্ষতি হয়নি।’’ কি করে জানলেন? এ বার তাঁর জবাব, ‘‘মাস দেড়েক আগে অফিসাররা এসে দেখে গিয়েছেন।’’ তা শুনে মসজিদ লাগোয়া বাসিন্দারা বলছেন, ‘‘ভূমিকম্প হল ১২ দিন আগে। তারপর কেউই আসেননি। খোদ কেয়ারটেকার জাকির হোসেনই তো আসেননি। তাঁর বাড়ি খেরুর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে বহরমপুরের শিয়ালমারা এলাকায়। তিনি কালেভদ্রে খেরুরে পা রাখেন। তিনি এ বারের ভূমিকম্পে মসজিদের ক্ষতির কথা জানবেন কি করে!’’

ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের কলকাতা মণ্ডলের সংরক্ষণ সহায়ক সুদীপ্ত সেন বলেন, ‘‘সংস্কারের জন্য ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের কলকাতা মণ্ডলের অধিকর্তার কাছ থেকে আমাদের কাছে প্রস্তাব এলে তখন আমরা সংস্কারের কাজে হাত লাগাই। ওই মসজিদের সংস্কার বিষয়ে এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে কোনও প্রস্তাব আসেনি। কলকাতা মণ্ডলের অধিকর্তা কলকাতার বাইরে আছেন। তিনি ফিরলে খেরুর মসজিদের সংস্কার সংক্রান্ত বিষয়ে বোঝা যাবে।’’ ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের কলকাতা মণ্ডলের অধিকর্তা এ কে প্যাটেলের মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement