নদিয়া জেলার বর্তমান প্রশাসনিক কার্যালয়। —ফাইল ছবি
তিনটে দিন ছিল অনিশ্চয়তা আর বিভ্রান্তির। ১৫ থেকে ১৭ অগস্ট। নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, মালদহ ও পশ্চিম দিনাজপুর— এই চার জেলার এবং বনগ্রাম থানার মানুষ ভারতের নাগরিক হবেন না কি পাকিস্তানের, তা নিয়ে চিন্তায় কেটেছে তিনটি বিনিদ্র রজনী।
১৯৪৭ সালের ৩ জুন ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভারত ভাগের প্রস্তাব মেনে নেয়। স্থির হয়ে যায়, ১৪/১৫ অগস্ট ভারত ও পাকিস্তান দু’টি পৃথক দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। সীমানা নির্ধারণের জন্য বেঙ্গল বাউন্ডারি কমিশনের পেশ করা রিপোর্টের উপরই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
’৪৭ সালের ৩০ জুন স্যার সিরিল র্যাডক্লিফকে চেয়ারম্যান করে পাঁচ জনের কমিশন গঠিত হল। প্রকৃত পক্ষে ১৮ জুলাই থেকে ১২ অগস্ট পর্যন্ত মাত্র ২৫ দিন তারা হাতে পায়। ১২ অগস্ট র্যাডক্লিফ তাঁর রিপোর্ট পেশ করেন। ১৯০৫ সালে যা ছিল বঙ্গভঙ্গের মহড়া, দেশভাগের মধ্যে দিয়ে তা পেল পরিণতি। ১৯০৫-এর মানচিত্র অনুযায়ী দিনাজপুর, মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, যশোহর এবং বনগাঁ থানাকে ‘পূর্ববঙ্গ’-এর মধ্যে ধরা হয়েছিল। সেই সময়ে তৈরি মানচিত্রকে ভিত্তি করেই র্যাডক্লিফ নতুন একটি মানচিত্র করেন।
দ্বিখণ্ডিত স্বাধীনতা ঘোষিত হতেই ১৯০৫ সালের আঁকা মানচিত্রকে রিপোর্টে পেশ করা হয়েছে বলে সুকৌশলে প্রচার করে মুসলিম লিগ ময়দানে নামে। ১৫ অগস্ট সকালে লিগের সমর্থকরা মিছিল-মিটিং করে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করতে রাস্তায় নামে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে কংগ্রেস, হিন্দু মহাসভা, নিউ বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশনের নেতারাও বিভ্রান্ত হন। কৃষ্ণনগর পাবলিক লাইব্রেরির মাঠে মুসলিম লিগের সঙ্গে কংগ্রেস নেতারা উপস্থিত থেকে পাকিস্তানের পতাকা তোলেন। শহরের নানা জায়গায় পাকিস্তানের পতাকা ওঠে।
বেলা বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে শুরু হয় পাল্টা তৎপরতা। বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা, কৃষ্ণনগরের মহারানি জ্যোতির্ময়ী দেবী, মুর্শিদাবাদের ওয়াসেদ আলি মীর্জাদের তরফ থেকে রাজ্য ও সর্বভারতীয় স্তরে যোগাযোগ করা শুরু হয়। ১৬ অগস্ট তৎপরতা তুঙ্গে ওঠে। কলকাতা থেকে দিল্লির প্রশাসনিক স্তরে চিঠি চালাচালি ও দরবারের পর ১৭ অগস্ট বিকালে নতুন নোটিফিকেশন মারফত নদিয়া জেলাকে দু’টুকরো করে ‘নবদ্বীপ’ ও ‘কুষ্টিয়া’ জেলা গঠন করা হয়। নবদ্বীপ থানার নাম হয় নদিয়া থানা। নবদ্বীপ জেলায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় কৃষ্ণনগর ও রানাঘাট মহকুমাকে।
অবিভক্ত নদিয়ার পাঁচটি মহকুমার মধ্যে কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙা ও মেহেরপুর মহকুমাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মেহেরপুর মহকুমার করিমপুর ও দৌলতপুর থানাকে চিহ্নিত করে মাথাভাঙা নদীর মাঝ বরাবর সীমানা নির্ধারণ করা হয়। র্যাডক্লিফ রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা ও নদীকে বাঁচিয়ে বিভাজন করেছিলেন। ১৯০৫ সালের মানচিত্রে যা করা হয়েছিল, সে ভাবে গঙ্গাকে পাকিস্তানের পশ্চিম সীমানা বলে ধরা হয়নি।
নদিয়ার ভারতভুক্তির সংবাদ প্রচারিত হওয়ার পরের দিন আবার কৃষ্ণনগর পাবলিক লাইব্রেরির মাঠে মুসলিম লিগ নেতাদের উপস্থিতিতে কংগ্রেস নেতারা ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। ১৯ অগস্ট রাজবাড়ির মাঠে শেষ বার নদিয়ারাজকে সেনাবাহিনীর গার্ড অব অনার দেওয়ার পরে রাজপতাকা নামিয়ে তেরঙ্গা পতাকা তোলা হয়।
১৯৪৮ সালে ২৩ ফেব্রুয়ারি ‘নবদ্বীপ’ জেলার নাম পরিবর্তন করে ফের ‘নদিয়া’ রাখা হয় এবং ‘নদিয়া’ থানার নাম বদলে আবার ‘নবদ্বীপ’ থানা করা হয়।
এর পর আর ভাঙাগড়া হয়নি।
লেখক অবসরপ্রাপ্ত গ্রন্থাগার কর্মী