প্রতীকী ছবি।
বিজয়া দশমীর বিকেল। পড়ন্ত সূর্যের আলো আর সিঁদুরের লালে মাখামাখি হয়ে ফিরছে কয়েক জনের একটি দল। নদীতে দুর্গা প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে ঘরে ফিরছেন তাঁরা। সামনে এক জনের মাথায় জলভরা ঘট। তিনি আকুল কণ্ঠে গাইছেন “মাকে ভাসাইয়া জলে কী ধন লইয়া যাইব ঘরে। ঘরে গিয়া মা ডাকিব কারে…” প্রতিমাহীন দুর্গা দালানের শূন্যতা ছেয়েছে মাঠ-ঘাট-পথ। অবিভক্ত বাংলাদেশের মাধবপুর গ্রামে ছোটবেলার বিসর্জনের এই স্মৃতিচারণ নবদ্বীপের প্রখ্যাত পণ্ডিত প্রয়াত রাজেন্দ্রচন্দ্র তর্কতীর্থের। দশমীতে দুর্গা বিসর্জনের উন্মাদনায় বীতশ্রদ্ধ মানুষটি আক্ষেপের স্বরে বলেছিলেন, ‘‘মায়ের চলে যাওয়া দিনে যারা এমন আনন্দ করে তারা কুপুত্র।’’
অনেক বছর পর করোনা কালের দশমীর বিকেলে সেই ফেলে আসা দিনের পুনরাবৃত্তি ঘটল। প্রবল শব্দে বাজি ফাটিয়ে, গগনভেদী ডিজের সঙ্গে উদ্দাম নেচে প্রতিমা বিসর্জন নয়। প্রশাসনের নজরদারিতে হাতে গোনা গুটিকয় মানুষ। সঙ্গে একটি কী দু’টি ঢাক। অতিমারি কালের দশমী ছিল শান্ত, বিষণ্ণ। হেমন্তের হিম সন্ধ্যায় ‘মাকে ভাসাইয়া জলে’ ফেরার সময় চেনা চিৎকার ‘আসছে বছর আবার হবে’ সে ভাবে শোনা গেল না এবার।
“এ বার বিসর্জনের পর এত মনখারাপ করছিল, যেটা আগে কোনও দিন হয়নি। বিসর্জনের পর কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না। ঢাকিকে বাজাতেও বারণ করলাম”— বলছিলেন নবদ্বীপের একটি ছোট বারোয়ারির উদ্যোক্তা মলয় চৌধুরী। সোমবার বিকেল বা সন্ধ্যায় এই নদিয়ার গঙ্গা থেকে জলঙ্গি, চূর্ণী থেকে ইছামতির পাড়— সর্বত্র ছবিটা ছিল প্রায় একই রকম। শুধু ঢাক নিয়ে দিনের বেলা সাদামাটা ভাবে প্রতিমা বিসর্জন।
রানাঘাট শহর লাগোয়া পান্থপাড়ার পুজোর শোভাযাত্রা গত কয়েক বছর ধরে মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। যা দেখার জন্য রাস্তার দু’ ধারে হাজার হাজার মানুষ অপেক্ষা করেন। এ বার ছবিটা একদম বিপরীত। পুজো কমিটির সম্পাদক সঞ্জীব সরকার বলেন, “এ বার পুজো থেকে বিসর্জনের অনেক কিছুই বাদ দিয়েছি। মঙ্গলবার দুপুরে মাত্র একটি ঢাক নিয়ে প্রতিমা বিসর্জন দিতে গিয়েছিলাম।” রানাঘাট শহরের পূর্ব পাড়ে পাইকপাড়া ব্রতী সঙ্ঘের পুজোয় অন্য বছর শোভাযাত্রা সহযোগে দুপুরে ঘট এবং রাত্রে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়। তাদের শোভাযাত্রাও নজরকাড়া। পুজো কমিটির সম্পাদক সুব্রত দত্ত বলেন, “করোনার কারণে এ বার শোভাযাত্রা বাতিল করা হয়েছে। শুধুমাত্র ঢাক নিয়ে ঘট ও প্রতিমা বিসর্জন দিয়েছি।”
তবে নদিয়ার বাদকুল্লায় অবশ্য সোমবার বড় পুজোর বিসর্জন হয়নি। বুধবার থেকে বিভিন্ন বারোয়ারি তাদের প্রতিমা নির্দিষ্ট সময়ে বিসর্জন দেবে। ফুলিয়ায় কোনও শোভাযাত্রা ছাড়া ন্যূনতম লোক নিয়ে প্রতিমা বিসর্জন পর্ব মিটেছে। নদীর ঘাটে ক্রেনের ব্যবস্থা ছিল।
বেথুয়াডহরি বিসর্জনেও ছিল সেই মনখারাপের আবহ। এ বছর নিঃশব্দেই চলে গেলেন মা। করোনা কালে বির্সজনের আনন্দ হুলোড় সম্পূর্ণ ভাবে বন্ধ রাখার নির্দেশ ছিল আর তাতেই বিসর্জন জৌলুসহীন। অন্য বার বেথুয়াডহরি দশমীর সন্ধ্যায় আলো আর বাজির শব্দে ভরে ওঠে। সোমবার ছিল ব্যতিক্রম। প্রতিটি পুজো কমিটি মণ্ডপের সামনে বাজনা বাজিয়ে ভাসানের আনন্দ সেরেছেন।
পলাশির পুজোয় দশমীর সন্ধ্যার অপেক্ষা করেন মানুষ। কোন কমিটি নতুন কী করে, তা দেখার জন্য। এ বার অবশ্য কোনও অপেক্ষা ছিল না। শুধু কয়েকটা ঢাক আর কয়েক জন মিলে প্রতিমা বির্সজন।
জৌলসুহীন বিসর্জনেই এ বার দেবীর কৈলাস-গমন।