অস্ত্রোপচারের পরে তুফানের পাশে প্রণব ঘোষ। —নিজস্ব চিত্র।
ইনি যেন সেই তিনি।
বাসের জানলায় এক ঝলক মুখ দেখে যাঁর বুকের বাঁ দিকটা চিনচিন করে ওঠে না।
ঝগড়া করতে করতে হঠাৎ বুকের বাঁ দিক চেপে ধরে (ফিল্মি স্টাইল) বসেও পড়েন না যিনি।
সাইকেলের বেল থেকে ছিটকে সজারুর কাঁটা বুকের বাঁ দিকে এসে বিঁধলেও যিনি টপ করে মরে যান না, বরং অপেক্ষা করেন ব্যোমকেশকে সূত্রটা ধরিয়ে দেবেন বলে।
অমোঘ সেই সূত্র!
হৃদয় হোক বা হৃদপিণ্ড— যে নামেই ডাকো, সে বস্তুটা যে
বুকের বাঁ দিকে নেই তাঁর। সাইড বদলেছে। ভয়ে ঢিপঢিপ থেকে প্রেমে রিনরিন, হৃদরোগে ঝিনঝিন— সব তাই সাইড বদলে চলে গিয়েছে
ডান দিকে।
শুধু কি হৃদপিণ্ড? ভিতরের গোটা যন্ত্রপাতিই— অ্যাপেন্ডিক্স, অগ্ন্যাশয়, লিভার, পাকস্থলী সব উল্টো দিকে, এমনকী অন্ত্রও উল্টো প্যাঁচ খেয়ে নেমেছে নীচে। এমন এক জনের পেটে ছুরি-কাঁচি চালানো যে সহজ কাজ নয়, বলাই বাহুল্য। এ যেন ডানহাতি শচীনকে সৌরভের স্টান্সে অফ ড্রাইভ মারতে বলা!
ঠিক সেই কাণ্ডটাই ঘটিয়েছেন শক্তিনগর জেলা হাসপাতালের চিকিৎসকরা। তেহট্টের বরেয়া নতুন পাড়ার চল্লিশ পেরনো তুফান বর্মন পেটে ব্যথা আর বমি নিয়ে সেখানে ভর্তি হয়েছিলেন গত ১৫ মে। পরীক্ষা করতে গিয়ে ডাক্তারদের চোখ কপালে। যেন আয়না দিয়ে দেখছেন দেহের ভিতরটা, উল্টো দেখাচ্ছে সব। পেটে ব্যথার কারণ ছিল ক্ষুদ্রান্ত্র আর পাকস্থলীর মাঝে ডিওডিনামে ফুটো (গল্প হলে বলা যেত, সজারুর কাঁটা ওখানেই বিঁধেছিল)। ফুটো মেরামত করা শক্ত কিছু নয়। কিন্তু এই ধরনের রোগীর দেহে অস্ত্রোপচার করাটাই শক্ত কাজ।
শেষমেশ দিন চারেক আগে শল্য চিকিৎসক প্রণবকুমার ঘোষের নেতৃত্বে অস্ত্রোপচার করা হয়। এখন তিনি প্রায় সুস্থ। দিন দুয়েকের মধ্যে তাঁকে ‘ছুটি’ দিয়ে দেওয়া হবে বলে হাসপাতাল সূত্রের খবর। প্রণববাবুর দাবি, ‘‘বিপরীত দিকে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থাকা রোগীর এই ধরনের অস্ত্রোপচার বেশি হয়নি। হেলথ জার্নালেও মোটে খান দুই রেকর্ড পেয়েছি।’’ নদিয়ার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক তাপস রায় বলেন, “এই ধরনের রোগীর অস্ত্রোপচারে ঝুঁকি থাকে। তাই খুব কম দেখা যায়।”
কী বলছেন তুফান?
‘‘বছর কুড়ি আগে এক বার খুব পেট ব্যথা হয়েছিল। ডাক্তার দেখিয়ে সেরেও গিয়েছিল। এ ছাড়া কখনও এক্স-রে বা আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করার দরকার হয়নি। সব যে উল্টে বসে আছে, কে জানত!’’
ফাঁড়া কেটেছে। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে তুফান অপেক্ষায়, ছুটি দেওয়ার আগে কেউ তাঁকে ‘সজারুর কাঁটা’ উপহার দেয় কি না!